সোমবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০১৫ |
২:৫৬ পূর্বাহ্ণ | 541 বার
কথায় আছে , হাতি খাদে পড়লে চামচিকায়ও একটা লাথি মারে । বাস্তব জীবনে এই আপাত গ্রাম্য কথাটির প্রতিচ্ছবি আমরা প্রতিনিয়ত ফুটে উঠতে দেখি । মানবতা বিরোধী অপরাধে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কিছুদিন আগে ফঁসি হয়ে গেল। আর সেই বিচার , ফাঁসি ও তার পরবর্তী অবস্থা নিয়ে পত্র পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নানান পক্ষ বিপক্ষ মতামত আমরা দেখেছি । বিষয় যখন রাজনৈতিক, তখন পক্ষে বিপক্ষে মন্তব্য থাকবেই । তবে কোনো ভাল লেখকের কাছ থেকে অসাড় যুক্তি কেউ আশা করে না । অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কলামিস্ট অজয় দাশগুপ্তের একটি একপেশে মন্তব্যে আমরা অনেকেই অবাক হয়েছি ।
অজয় দাশগুপ্তের একটি বই পড়ে খুব পছন্দ হয়েছিল ।’ একাত্তরের ৭১ ‘ নামের সেই বইয়ে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খুব ভাল কিছু বর্ননা অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় করতে পেরেছেন । ফলে তার প্রতি যে প্রত্যাশা , সেটা তিনি নিজের যোগ্যতায় বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন । আর প্রত্যাশা যখন থাকে ,তখন পূরন না হওয়ার হতাশাও থাকবে । সেইরকম এক হতাশাবোধ থেকেই হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে নিয়ে তার একপেশে মন্তব্যের সমালোচনা না করে পারলাম না। যদিও এই সমালোচনা আমার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন । যে কেউ পেরে না উঠলে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি বলে ট্যাগ দিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। লেখালেখি করতে গিয়ে নানান ট্যাগ খাওয়ায় আমি অভ্যস্ত। তাই বলে যা কিছু যুক্তিযুক্ত মনে হয় তা লিখবো না এমনটি নয়।
একাত্তরের মানবতা বিরোধীদের যে বিচার , সেটা আমাদের জাতির জন্য বিরাট একটি অর্জন হতে পারতো । যদি এই বিচারটি নিরপেক্ষতার মানদন্ডে সবার প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হত । সর্বশেষ জাতিসংঘ থেকেও এই বিচারপ্রকৃয়ার নিরপেক্ষতা ও মান নিয়ে পরিস্কার প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এই বিচারকে অনিরপেক্ষ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রোণোদিত বলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে যে কোনো নিরপেক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী মানুষের উচিত ছিল বিচারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো। দেশে রাজনৈতিক কারনে যে অনেক কিছুই হয় ও হচ্ছে ,এটা তো সত্য। সেসব অগ্রাহ্য করে একপেশে চিন্তাগুলো যখন কারো লেখায় প্রকাশ পায়, তখন অবাক হতেই হয়।
অজয় দাশগুপ্ত তার লেখাটিতে প্রচুর পরস্পর বিরোধী মন্তব্য করেছেন । সেই সাথে বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাও আছে। তিনি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে প্রথমেই উম্মাদ ও বিকৃত মনস্ক বলেছেন । আমি জানিনা ওনার মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান কতটা । কাউকে উম্মাদ বা বিকৃত মনস্ক বলার মত ডিগ্রী ওনার আছে কিনা । আমি মনোবিজ্ঞানের উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছি । কাউকে উম্মাদ বা বিকৃত মনস্ক বলতে গেলে নানান হিসেব মেলাতে হয়। ফলে এভাবে ঢালাও মন্তব করা হয়ে ওঠে না । আমি ধরে নিচ্ছি তিনি উম্মাদ ও বিকৃত মনস্ক বলতে অস্বাভাবিক আচরন ( এবনরমাল বিহেভিয়ার ) বোঝাতে চেয়েছেন । যা ঠিক উম্মাদ বা পাগলের প্রতিশব্দ নয়। অজয় দাশগুপ্ত হম্মাম কাদের চৌধুরীকে প্রকৃতপক্ষে পাগল মনে করলে তাকে নিয়ে লেখার প্রয়োজনই হতো না । আমরা নিজেরা সুস্থ থাকলে একটি পাগলের আচার আচরন নিয়ে আর যাই করি লেখালেখি করবো না । সুতরাং বিষয়টা পরস্পর বিরোধী । হয় তিনি উম্মাদ বা বিকৃত মনস্ক শব্দগুলির ব্যবহার বুঝতে পারেন নি , অথবা নিজে লিখেছেন বটে কিন্তু বিশ্বাস করেন না ।
তারপরেও যুক্তির খাতিরে আমরা বিষয়টিকে খুঁটিয়ে দেখি । পাঠকরা ক্লিয়ার হতে পারবেন । হুম্মামের বাবার ফাঁসি হলো, দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি যেটাকে অনিরপেক্ষ বিচার বলেছে, বিশ্ব সংস্থাগুলো অনিরপেক্ষ বিচার বলেছে সেই প্রেক্ষাপটে হুম্মামের কি ভাবা উচিত । তার কোন আচরন স্বাভাবিক হওয়ার কথা ? তার বাবার বিচারটির স্বচ্ছতা নিয়ে যেহেতু প্রশ্ন আছে, সেহেতু সে এর পাল্টা বিচার চাওয়াটা কতটা উম্মাদের লক্ষন আর কতটা সুস্থতার সেই বিবেচনার ভার পাঠকরাই নিক । কোনটা উম্মত্ততা, বিচার চাওয়া, নাকি লাশের পাশে বসে খুশি হওয়ার ভান করে মিষ্টি খাওয়া ?
চতুর কলামিস্ট অজয় দাশগুপ্ত এর পরে লিখেছেন , সাকা চৌধুরীর অনেক আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হওয়ার কথা ছিল। যদিও আদালতে এই বক্তব্যগুলি খুব ক্লিয়ার প্রমানিত হয়নি। তবুও রাজনৈতিক বিবেচনায় দুটি প্রশ্ন করি । এই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সখ্যতার খবর আমরা জানি । আমার প্রশ্ন , আজকে অজয় দাশগুপ্ত যা বলছেন, তা কি তখন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জানতেন না? তবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দিয়ে রাজনৈতিক লিয়াজো করানোর চেষ্টা , ঘন্টায় ঘন্টায় তার সাথে টেলিফোন আলাপ ইত্যাদি কিভাবে সম্ভব হয়েছিল?
এরপরে তিনি স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন । মৃত্যু তো বঙ্গবন্ধু অথবা জিয়াউর রহমানেরও অস্বাভাবিক হয়েছে। রাজনৈতিক হত্যাও স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এভাবে গ্রাম্য খোঁটা দেয়ার আগে তার ভাবার দরকার ছিল, জেলখানায় মৃত্যু অনেকেরই হতে পারে । সক্রেটিস থেকে শুরু করে চে গুয়েভারা পর্যন্ত অনেকেই জেলখানায় মৃত্যুবরন করেছেন । আর বাংলাদেশে ৭৪ সালে মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাইতো , সেই অবস্থা এখনও আছে । যে কেউ যে কোনো সময় খুন বা গুম হয়ে যায়। কেউ নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী বলবে , আবার ইলিয়াস আলীকে গুম করে ফেলবে, আবার তার সন্তানকে যদি খোঁটাও দেয় তোমাদের পরিবারে কি গুম হওয়ার ঐতিহ্য আছে নাকি ? তবে বিষয়টা কিভাবে দেখবেন পাঠকরা ?
এরপরে তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে কয়েকটি লাইন লিখেছেন। আমি খুব হতাশ হয়েছি তার এ সংক্রান্ত ধারনা দেখে । রাজনীতি আর ধর্মকে এক করার পক্ষে আমি নই । তবে বাস্তবতাকেও অস্বীকার করবো না। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পৃথিবীতে বিশেষ একটি স্থান দখল করে আছে। কিন্তু সেই রাজনীতি যারা করেন , তাদের রাজনীতিবিদ হতে দেখেছি, সাধু সন্নাসী বা পীর হতে দেখিনি । যেমন নরেন্দ্র মোদী ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করেন কিন্তু তিনি বড় ধর্মীয় গুরু নন । একসময় সাদ্দাম হোসেন ইসলামের ঝান্ডা বয়েছেন, তারপরেও ইসলামকে বাদ দিয়ে বলতেন আরব লীগ আমার ধর্ম। মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ব্যক্তি জীবনে খুব একটা ধার্মীক ছিলেন না এমনকি বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বলেছেন, আমরা প্রথমে মুসলিম তারপরে বাঙালী। সাতচল্লিশে আমাদের দেশ বিভক্ত হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে । যাই হোক অনেক বড় লেকচার হয়ে যাবে বিষয়টি বোঝাতে গেলে । শুধু এতটুকু বলি , ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি করা মানে এই নয় যে দাড়ি টুপিওয়ালা বা সাধু সন্নাসীভিত্তিক দলে ভিড়তে হবে।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন । তার লেজে কুকুর নাড়ানোর সেই মন্তবে একসময় বহিস্কারও হয়েছিলেন। দলে থাকলে এগুলো হয়। শেখ সেলিম শেখ হাসিনার দুর্নীতির কথা বলেছেন, ওবায়দুল কাদের ওয়ান ইলেভেনে অনেক কথাই বলেছেন সেনাবাহিনীর কাছে । সেই ভিডিও এখনও ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। দলে থাকলে সমালোচনা করার মানসিকতা থাকতে হবে । আর সেটা তো গুনই । যে যেভাবে দেখেন।
চট্রগ্রামের জনগন সালাউদ্দিন চৌধুরীকে বার বার ইলেকশনে জিতিয়ে দিয়েছে । ছয়বার তিনি জনগনের ভোটে এমপি হয়েছেন। ত্রিশ বছর ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সহজ কথা না । আজকে যারা চেতনার কথা বলেও ইলেকশন থেকে যে কোনো ভাবে হোক দূরে পালাচ্ছেন, তাদের তো অন্তত এই বোধ থাকা দরকার ছিল।
সর্বশেষে তিনি ব্যাক্তিগত আক্রমনকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন । হুম্মাম কাদের চৌধুরীর পরিধেয় পাজামা আর পাঞ্জাবীকে তিনি পাকি পোশাক বলেছেন। আমি জানিনা তিনি এটা কেন লিখলেন । বেফাঁস কথাবার্তারও তো একটা সীমা আছে । পাজামা পাঞ্জাবী ইসলামী পোশাক । পাকি পোশাক নয়। বাংলাদেশেও প্রচুর রাজনীতিবিদ পাঞ্জাবী পড়তেন । এমনকি বঙ্গবন্ধু নিজেও পাঞ্জাবী পড়তেন। শার্টের যেমন নানান কাটিং হয়, তেমনি পাঞ্জাবীরও হয়।
যাই হোক , আমরা অনেক সময় অতি আবেগে বা প্রতিহিংসায় যুক্তিজ্ঞান হারিয়ে ফেলি । আর তখন খেয়াল থাকে না কোথায় কি বলছি , কেন বলছি। তবুও যারা নিজেদের প্রত্যাশার যায়গায় নিয়ে যেতে চান তাদের কাছ থেকে হতাশা কেউ আশা করে না ।