পরিকল্পিত উন্নয়নের ছোঁয়াতে বদলে গেছে বা যাচ্ছে বাংলাদেশ। বদলে যাচ্ছে- দেশের জনপ্রিয় ইতিহাস, ঐতিহ্যের তথ্য আদান-প্রদানের বৃহৎ মাধ্যম ডাকঘর। তমধে বদলেও গেছে ছোট্ট একটি শব্দ চিঠি, তার মাধ্যমে আদানপ্রদানের প্রচলন। এমন চিঠির প্রচলন ও ইতিহাসটা ছিল অনেক পুরোনো। চিঠি অথবা পত্রের মাধ্যমে একজনের পক্ষ থেকে অন্যজনের কাছে লিখিত তথ্যধারক বার্তা বললেও ভুল হবে না।
চিঠিতেই দুজন বা দুপক্ষের মধ্যেই যেন যোগাযোগ বজায় রাখে। বলাই চলে যে, বন্ধু এবং আত্মীয় স্বজনদের খুবই ঘনিষ্ট করে, পেশাদারি সম্পর্ককে খুব উন্নয়ন করে এবং আত্ম প্রকাশের সুযোগ প্রাণবন্ত করে তোলে। কিন্তু ‘ডিজিটাল সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে’ এসেই চিঠি লেখার পাট শেষের পথে। নিজ হস্তে চিঠি লেখার প্রচলন এখন নেই বললেই চলে। কালি কলম বা বল পেনের মাধ্যমেই চেয়ারে বসে ঠিক টেবিলের উপর সাদাকাগজ কিংবা রঙিন কাগজে চিঠি আর লেখেনা।
বলতেই হয় যে আধুনিক যুগে উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কালের গর্ভেই যেন এমন এই মাধ্যমের ব্যবহার বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। স্ব-হস্তে লেখা চিঠির মধ্যেই হৃদয়ের শত সহস্র কথা ও তার আবেগ, আকুলতা এবং ব্যাকুলতা সব বিষয় প্রকাশ পেত। মা-বাবা তাঁর সন্তনের হাতের লেখা চিঠিটা যখন কাছে পেত, ঠিক তখনই যেন লেখাটিতে কোমল হৃদয় দিয়ে পড়ে। চিঠির মধ্যেই বাবা মা নিজের সন্তানের মুখটাও দেখতে পেতো। অবচেতনে চিঠি বুকে জড়িয়েও আদর করে। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ চিঠি আদানপ্রদান করেছে, ইলিয়াডে তার উল্লেখ ছিল। হিরোডোটাস ও থুসিডাইডিসের রচনাবলীতে তা উল্লেখ করাও আছে।
অশিক্ষিত মানুষরা শুধুমাত্র চিঠি পড়া ও লেখার জন্যেই যেন স্বাক্ষরতা অর্জনের খুব চেষ্টা করেছিল। সেই সময়ে স্বাক্ষরতা টিকিয়ে রাখার বিশাল অবদান ‘চিঠি’। আবার পারিবারিক চিঠি গুলো অনেক সময় খবরের কাগজের বিকল্প হিসাবেই যেন ব্যবহার করেছিল। কোনো চিঠিতে গ্রামের যেকোন ঘটনা ও আশা ভরসার খবর, আবাদের খবর বা প্রকৃতিক দুর্যোগের খবরসহ বিভিন্ন খবর লেখা থাকত। আসলে, হাতে লেখা চিঠি পরিবারের মধ্যে যেন নিবিড় সম্পর্ক ও ভালবাসার গভীরতার সেতু বন্ধন সৃষ্টি হতো।
প্রেম ভালোবাসার চিঠি গুলো তো ছিল একেকটি কালজয়ী বৃহৎ প্রেমের ইতিহাস। প্রচলিত চিঠির যুগেরই সকল প্রেমিক-প্রেমিকা’রা হৃদয়ের আকুলতা-ব্যাকুলতা কিংবা প্রতীক্ষার প্রহরের খুঁটি নাটি অনেক কিছুই সহজ সরল ভাষায় মনের মাধুরীতে লিখত। যা পড়ে পুলকিত হওয়ার পাশাপাশি তা সংগ্রহ করে রাখতো। চিঠিগুলোর ভাষা ও ভাবকে মনেই হতো শত ফুল দিয়ে গাঁথা একটি গল্প বা উপন্যাস। বিশ্বের সবচেয়ে বড় চিঠিটা লিখেছিল নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের একজন নারী তার প্রেমিককে। ১৯৫২ সালে কোরিয়াতেই যুদ্ধ চলাকালীন সময় লেখে। তখন তার প্রেমিক মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন যুদ্ধের সৈনিক ছিল। সেই চিঠিটার দৈর্ঘ্য ছিল ৩ হাজার ২০ ফুট লম্বা যা লিখতে সময় লেগেছিল একমাস।
আবার খুবই ক্ষুদ্র চিঠি লিখেছিল চমৎকার ভাষাতে ফ্রান্সের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো। তা ছাড়াও আর এক ঘটনা স্মরণ করার মতোই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শৈশবের লেখা একটি চিঠি বা পত্র সম্পর্কে বলতেই হয়, তিনি বাড়ি থেকে বহুদূরে পড়তে গিয়েই সবেমাত্র বাংলা স্বরবর্ণের পরিচয় হয়েছিল। তখন তাঁর টাকার প্রয়োজন হয়েছিল। তিনি কী আর করবে, শুধু মাত্র স্বরবর্ণ দিয়েই বাবার কাছে চিঠি বা পত্র লিখেছিল। বর্ণের সাথে ‘কার’ যোগ করলে তা ঠিক এমনটি হয় ‘বাবা টাকা পাঠাও তো পাঠাও, না পাঠাও তো- ভাত অভাবে মরি’।
তাঁর চিঠিতে এই ভাবে লিখে ছিল- ‘বব টক পঠও ত পঠও ন পঠও ত ভত অভব মর’। চিঠি নিয়ে সে সময়ের বহু স্মৃতির মতো এখনকার আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি যুগে তেমন স্মৃতি স্মরণ রাখার মতো নেই বললেই চলে। চিঠিপত্র লেখাকে কেন্দ্র করেই বেড়ে গিয়েছিল চিঠি লেখাকে পেশা রূপে নেয়ার প্রবণতা। ডাকঘরের বারান্দায় লাইনের পর লাইন ধরেই সকল শ্রেণীর মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। ডাকটিকিট, পোস্টাল অর্ডার, ইনভেলাপ, রেজিস্ট্রিচিঠি, মনিঅর্ডার, পোস্ট কার্ড, বীমা, পার্সেল, জিএমই, ভিপিপি, ইএমএস, স্মারক ডাকটিকিট, ডাক জীবনবীমা, লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক সহ সরকারি কর্মচারীদের বেতন। এমনকি নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পও ডাকঘর থেকেই যেন সংগ্রহ করতো।
এ গুলো চাহিদাতেই চিঠিপত্রের আদান প্রদানের মাধ্যম খুব দ্রুতগতিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠ ছিল। তখনকার যুগে যে সব মানুষরা লেখাপড়া জানতোই না, ডাকঘরের লেখকেরা সেই ডাকঘরের বারান্দাতে কিংবা সুবিধাজনক স্থানেই চেয়ার-টেবিল বসিয়ে লেখাপড়া না জানা মানুষের পে চিঠিপত্র, মনিঅর্ডার কিংবা মালামাল প্রেরণসংক্রান্ত কাজ করে দিতো। ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু করে দেড় শ’ বছর পর্যন্তই ছিল চিঠিপত্রের রমরমা অবস্থা। গাঁওগেরামের বেশকিছু স্বল্পশিতি লোকজনরাই বিনে পয়সায় চিঠি লিখে দেওয়ার কাজ করতো। অবশ্য তাদের কদরই ছিল আলাদা।
তাদের এমন এই মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা সত্যিই প্রশংসনীয়। তারা যেন নাওয়া-খাওয়ার এতটুকু সময় পেতো না। আর এ যুগের মানুষ হয়েছে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। তখনকার দিনে পত্র মিতালীর প্রচলনও ছিল খুব বেশ। প্রতি বছর প্রচুর ছেলে-মেয়ের নাম ঠিকানা সম্বলিত পত্রমিতালী গাইডও পাওয়া যেত বিভিন্ন বুক স্টলে বা পত্রিকার স্টলে। এসব পত্রমিতালীর গাইড থেকেই অনেকে পছন্দের বন্ধু খুঁজে নিত আর শেয়ার করতো জীবনের সুখ-দুঃখের বহুগল্প। একজন অন্য জনকে চিঠি লিখতো অনেক সুন্দর করে। যাতে স্থান পেত বিভিন্ন কবিতার লাইন বা গানের কথা। ব্যবহার হতো বিভিন্ন বর্ণিল চিঠির প্যাডও। হলুদ খামের এক একটি চিঠি যেন একটি গীতি কবিতা।
আবার অনেক দিনের চিঠিগুলি তারা যেন ফেলে দিতো না। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সাইকেলের স্পোকের মাথায় বড়শির মতো করে তার মধ্যেই যেন গেঁথে রাখতো। সেই চিঠিগুলো তাদের নীরব স্বাক্ষী। বাজারে রাইটিং প্যাডও (চিঠি লেখার প্যাড) পাওয়া যেতো। রঙ-বেরঙের হরেক রকমের প্যাডে প্রিয়জনের নিকটে সুস্পষ্ট হরফে বিভিন্ন কালি বা কলমের মাধ্যমে চিঠি লিখতো। আবার চিঠিটা লিখে, আঠা দিয়ে খামের মুখটা বন্ধ করে তাতে স্ট্যাম্প সেঁটে, বহুদূর হেঁটে গিয়ে যেন ডাকবাক্সে চিঠি ফেলতো।প্রেম
সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র | শনি | রবি |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ||||
৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ |
১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ |
১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ |
২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ |
২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Development by: webnewsdesign.com