হে তারুণ্য, আমাদের ফোকাস‌ কোথায়?

বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ৯:১০ অপরাহ্ণ | 396 বার

হে তারুণ্য, আমাদের ফোকাস‌ কোথায়?
মো. জুয়েল রানা

একটি এলাকা, অঞ্চল, জেলা বা দেশের মানুষ কি কারণে গর্বিত হতে পারে? কি কি কারণে নিজেদেরকে সভ্য ভাবতে পারে? কোন উপাদানগুলো সমাজে বিদ্যমান থাকলে নিজেদেরকে উন্নত ভাবতে পারে? আমরা বর্তমানের শিক্ষিত প্রজন্ম সেগুলো বলতে গেলে ভুলেই গেছি।

আচ্ছা ভাবুন তো, এই যে আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে প্রয়োজনীয় ব্রাশ, টুথপেস্ট, পানি, ওয়াশরুম টাওয়েল ইত্যাদি কতকিছু ব্যবহার করি। মানসম্মত এই উপাদানগুলো তৈরিতে প্রয়োজন হয়েছে কতশত গবেষণা জ্ঞান বিজ্ঞানের অবদান।

আমরা কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য যে পোশাকটি পরিধান করি সেটার পেছনে রয়েছে অসম্ভব মেধাবী একগুচ্ছ মানুষের পরিশ্রম এবং জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার।

এরপর আমরা সকালে যে নাস্তা করি তার উপাদানগুলো সুষম কিনা, কোনটি আমাদের শরীরের জন্য ভাল বা মন্দ, কি পরিমাণ খাওয়া উচিত, সবকিছু নির্ভর করে পরিকল্পনামাফিক কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে এ পণ্যগুলো পাচ্ছি কিনা, পুষ্টি বিজ্ঞানের নিয়মমাফিক সেগুলো রান্না করছি কিনা এবং পরিমাণমতো খাচ্ছি কিনা তার উপর। সুস্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞানের মাধ্যমে এভাবে সারাদিন আমরা যা কিছু খাচ্ছি তার সবকিছুই উপরোক্ত বিজ্ঞানগুলোর উপর নির্ভরশীল।

সারাদিন যে খাবারগুলো খাচ্ছি তা রান্নাবান্নার জন্য যত রকম আধুনিক যন্ত্রপাতি রান্নাঘরে ব্যবহার করি তার সবকিছুর পেছনে রয়েছে জ্ঞান বিজ্ঞানের অবদান।

আমরা সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় যেখানেই যাই না কেন, যে পরিবহনটি ব্যবহার করছি তার সাথে রয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার।

যে রাস্তাটি ধরে যাচ্ছি সেই পাকা রাস্তাটি তৈরিতে অসংখ্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয় রয়েছে। যে কর্মস্থলে যাচ্ছি সে কর্মস্থলে একটু লক্ষ্য করলেই দেখবো সবকিছুর মধ্যেই জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তির ব্যবহার।

আমরা যোগাযোগের জন্য যে মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করছি এবং তার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দূরের মানুষটিকে একেবারে হাতের মুঠোয় নিয়ে আনছি এর পেছনে রয়েছে একদল মানুষের নিরন্তর গবেষণা।

এমনকি আমরা ধর্ম কর্মের জন্য যে প্রার্থনালয় ব্যবহার করছেন সেখানেও রয়েছে গবেষণালব্ধ প্রযুক্তির অবদান। আমরা যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিচ্ছে তার প্রতিটি উপাদানই নিরন্তর গবেষণার ফল।

এভাবে আর কত উদাহরণ দেব? এক কথায় বলতে গেলে, একটু লক্ষ্য করলেই দেখবো, আমরা ঘুম থেকে উঠার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত, এমনকি ঘুমন্ত অবস্থায়ও ঘুমানোর জায়গাটির প্রতিটি ব্যবহৃত জিনিসের পেছনে রয়েছে একদল মানুষের নিরন্তর প্রচেষ্টা, গবেষণা এবং অধ্যবসায়। সভ্য হওয়ার জন্য প্রকৃত শিক্ষা এবং সুস্বাস্থ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করে তা অর্জনের জন্য এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য একদল মানুষ রাতদিন গবেষণারত।

আমরা আরেকটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখবো, বর্তমান সভ্যতায় যা কিছু ভোগ করছি তা তৈরিতে ছিটেফোঁটাও আমাদের অবদান নেই।
অধিকাংশই ইউরোপ আমেরিকার যাদেরকে সারাদিন আমরা ইহুদী-নাছারা-খ্রিষ্টান বলে গালি দেয় তাদের তৈরি! এজন্যই তারা সভ্য, শ্রেষ্ঠ, সভ্যতার নেতৃত্বে।

এসবের যেগুলো আমাদের তৈরি বলে মনে করছি আসলে সেগুলোও তাদেরই গবেষণালব্ধ প্রযুক্তিতে কেবলমাত্র আমাদের কামলা দেওয়া বৈ কিছু নয়। যেমন আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের কাপড় তৈরি, কৃষকের ফসল উৎপাদন ইত্যাদি।

বাস্তব জীবনে খেয়াল করবেন, আমাদের যে কোন অর্জন, যেমন আমি চাষের জমিতে ফসল উৎপাদন করে যদি সফল হয় তবে তার সিংহভাগ সুবিধা আমিই ভোগ করব, হয়তোবা আশেপাশের কিছু মানুষ সেখানে কামলা দিয়ে সামান্য কিছু সুবিধা পাবে।
ঠিক তেমনি আমাদের জীবনে ব্যবহৃত সকল জিনিস যারা তৈরি করছে তারাই তার মূল সুবিধাভোগী হবে, এটাই স্বাভাবিক। তারাই উন্নত, তারাই সভ্য, তারাই শ্রেষ্ঠ। এটিই কি হওয়া উচিত নয়?

কিন্তু আমরা তা মানতে নারাজ। আমরা নিজেদেরকে তাদের চেয়ে উত্তম ভাবি, উন্নত ভাবি, সভ্য ভাবি! কানাডা-সুইজারল্যান্ড ইত্যাদির চেয়ে আমরা উন্নত দাবি করে সুখ পাচ্ছি! পক্ষান্তরে আমরা আসলে বাস্তবতাকেই অস্বীকার করছি।একদিকে বর্তমান সভ্যতার সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করছি, অন্যদিকে সভ্যতাকেই অস্বীকার করছি! আজব আমরা!

আমরা নিজেদের ডিজিটাল দাবি করি, অথচ বাস্তব জীবনে কতটুকু ডিজিটাল সুযোগ সুবিধা প্রয়োগ করতে পারি তা আশেপাশের দেশের সাথে একটু মিলিয়ে দেখি না।

শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য আমাদের কি করা উচিত সেটি আমরা বুঝতে বা মানতে চাচ্ছি না। আমরা এখনো বুঝতে পারি নাই, বর্তমান সভ্যতা যে জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তি-গবেষণার উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেখানকার প্রবেশ দ্বারেও এখনো আমরা পৌঁছতে পারি নাই। আশেপাশের সব দেশ এই বাস্তবতাকে কিছুটা না কিছুটা উপলব্ধি করেছে। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, এসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এবং সামাজিকভাবে এসব ক্ষেত্রে অবদান রাখা ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ সম্মানিত করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
আর আমরা কি করছি?

আমাদের কাছে এখনো নিজ এলাকার বা জেলার গৌরব করার বিষয় হচ্ছে- ওই জেলায় বড় কোনো আমলা বা রাজনীতিবিদ রয়েছে কিনা, বড় কোন খেলোয়াড় আছে কিনা, গায়ক-গায়িকা নায়ক-নায়িকা আছে কিনা অথবা কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি রয়েছে কিনা এসবের মধ্যে! আপনি রাত দিন তাদের কুর্নিশ করছেন, তাদেরকে বাহবা দিচ্ছেন।

এসব থেকে প্রমাণিত হয়, আমরা মানুষগুলো সামাজিকভাবেই বৈশ্বিক বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। আমরা যেখানে ফোকাস দেওয়া প্রয়োজন সেই জায়গায় আমাদের ফোকাস নেই।

জ্ঞানই শক্তি, কিন্তু পাশাপাশি এখন বলা হয় তথ্যই শক্তি। একসময় আমাদের কাছে কিছুটা জ্ঞান থাকলেও তথ্যের প্রাপ্যতা সহজ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে জ্ঞান ও তথ্য উভয়ই পাওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। আশেপাশের কোন দেশ কি করছে জানা এখন খুবই সহজ।

কিন্তু অবাক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি, তবুও আমরা হুজুগে বিশ্বাস করি। তবুও আমরা কোন কিছুর সাথে একটু বহির্বিশ্বের তথ্য ঘেঁটে নিজেদের অবস্থান তুলনামূলক বিবেচনা করতে পারিনা।
এজন্যই আমরা আমাদের ছাত্র রাজনীতি কেমন হওয়া উচিত বুঝতে পারি না, রাজনীতি কেমন হওয়া উচিত উপলব্ধি করি না, নেতৃত্ব কেমন হওয়া উচিত জানিনা।
আমরা বুঝতে পারি না শিক্ষার উদ্দেশ্য কি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কি হওয়া উচিত। সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে কি রকম বাজেট দিল সেটা নিয়ে আমরা একটুও মাথা ঘামায় না, প্রয়োজনে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে পারিনা। অর্থাৎ শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য, আমরা অনেকটাই চোখ থাকতেও অন্ধ জাতি। এই অন্ধত্বের মধ্যে যে যার মতো সুযোগ পাচ্ছে লুফে নিচ্ছে‌।

অন্ধত্ব থেকে মুক্ত হতে একতরফা রাজনীতিবিদদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের নিজের দিকে আঙ্গুল উঠাতে হবে, স্বাধীনতাত্তোর আজ অব্দি সকল রাজনৈতিক নেতৃত্বের সকল অপশাসনের সাথে সারা দেশের লাখ লাখ অরাজনৈতিক মানুষ জড়িত। কে নেই তাদের সাথে? সবচেয়ে বেশি আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটধারী তথাকথিত শিক্ষিত লোকজন।

শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ব্যাংক-বীমা থেকে শুরু করে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ তাদের নিজ নিজ স্বার্থে রাজনীতিবিদদের তোষামোদি করছে, অনৈতিক পথ বেছে নিচ্ছে এবং বলতে গেলে রাজনীতিবিদদের অপশাসনে উস্কানি দিচ্ছে। অথচ সবকিছুতেই আমরা দোষ দিচ্ছি রাজনীতিবিদদের।

আসুন আমরা আমাদের ফোকাস ঠিক করি। একটি রাষ্ট্রকে কখন সভ্য বলা যায়, সভ্য বলার প্যারামিটার কোনগুলো, একটি বিশ্ববিদ্যালয় কে কখন বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায়, মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারামিটার কি কি? একটি সমাজের ভিতরে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি কারা? কী তাদের প্যারামিটার?

একটু জানার চেষ্টা করি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে কোন মানুষগুলোকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দেওয়া উচিত, কাকে অতিথি করা উচিত। যতক্ষণ আমরা এগুলো বুঝব না, যতক্ষণ আমরা আমলা, পুলিশ, রাজনীতিবিদ এবং তথাকথিত আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া টাকার মালিকদের সম্মান করে দুমড়ে-মুচড়ে কুঁকড়ে তাদের সামনে মাথা অবনত করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে শিখবো না, ততক্ষণে মুক্তি মিলবে না।

যতদিন বিশ্বকে দেখার চোখ আমাদের তৈরি হবে না, জ্ঞান বিজ্ঞান গবেষণায় নিজেদেরকে সঁপে দেবো না, প্রকৃত সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শন করবো না, ততদিন পর্যন্ত বুঝে নিবেন, আমাদের ফোকাস ঠিক নেই। আমরা সত্যিকারের আস্ত এক একটা মস্ত বড় মাথামোটা গুজব!

সূত্র: দশ দিগন্ত

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০ 

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com