আজ ভ্যালেন্টাইন ডে

শনিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ | ১২:৫২ অপরাহ্ণ | 1113 বার

 

photo[1]আজ ভ্যালেন্টাইন ডে। সকালে অফিস ছিল। তাই প্রতি শনিবারের মতো ছেলেকে কোচিং স্কুলে নামিয়ে দিয়ে গাড়ী পার্ক করে হেটে কাজে যাচ্ছি। পথিমধ্যে দেখলাম একজন পাগল কিসিমের বয়স্ক লোক রাস্তার পাশের বেঞ্চিতে শুয়ে আছে। কি মনে করে মোবাইল ফোন দিয়ে একটা ছবি তুললাম। আর ঠিক সেই সময়ই আমার ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে নবধারা অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক বন্ধুবর আজাদ ভাই কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন।

রিঙের আওয়াজ পেয়ে ততক্ষণে পাগল মানুষটা জেগে উঠে বেঞ্চিতে বসেছে। আর অতি বিরক্ত নয়নে তার ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ধারনা ছিল পাগল কিসিমের লোকদের গাঢ় ঘুম হয়। কিছুটা শঙ্কিত আর ভয় নিয়ে স্টেজ ম্যানেজ করার জন্য বললাম, হাই!

সে আমার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে আমাকে মাপার চেষ্টা করলো। তারপর বিরক্ত ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। পরিস্থিতি দেখে মনে হলো সে পাশের খালি কোকের ক্যান আমার দিকে ছুড়ে মারবে। এই মুহূর্তে চলে যাওয়া ঠিক হবে না জেনে বিপদের ঝুঁকি নিয়েই বেঞ্চিতে তার পাশের খালি জায়গাটায় বসে পড়লাম। ঘড়ি দেখলাম। হাতে আধা ঘণ্টার মতো সময় আছে।

লোকটা আরেকবার মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকালো। মিনিট পাঁচেক বসার পর বিপদের সম্ভাবনা কেটে গেছে ভেবে উঠে পড়লাম। তারপর ভদ্রতা করে বললাম,

তোমার ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য দুঃখিত। পাগল আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল,

ঠিক আছে। আমার বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠতেই সে বলল,

কাছে কোথাও কাজ কর বুঝি?

হ্যাঁ, সামনের ঐ শপিং মলের ভিতর।

আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার নাম বললাম।

সেও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

আমার নাম মাইকেল কিটস। আমি গত সপ্তাহে পার্থ থেকে সিডনিতে এসেছি। তুমি, তুমি কি ইন্ডিয়ান কিংবা ফিজিয়ান?

না, বাংলাদেশী।

ওহ ক্রিকেটের বাংলাদেশ?

আমি গর্বভরে মাথা দুলিয়ে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ। তা তুমি ক্রিকেট খেলা দেখো নাকি?

না না ওইসব খেলা টেলা আমি দেখি না। আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম,

এই ভ্যালেন্টাইনের সকালে রাস্তার বেঞ্চিতে শুয়ে আছো কেন? মাইকেল আরেকবার বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। হয়তো মনে মনে ভাবছে আমাকে বিশ্বাস করা যায় কিনা?

আমি উঠে দাঁড়ালাম। সে আমাকে ইশারায় বসতে বলল। তারপর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

আমি গ্রাজুয়েশন শেষ করে পার্থে একটা মালটি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ শুরু করি। কিছুদিন পর আমার এক কলিগকে বিয়ে করি। পার্থে আমরা দুজনে মিলে একটা বাড়ি কিনি। বছর খানেক পর আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমি বাড়ীর মালিকানা হারাই। চারবছর পরে অতীতের সব কিছু ভুলে গিয়ে আবার খুব দেখেশুনে অন্য একজনকে বিয়ে করি। অনেক কষ্টের সঞ্চয় জমিয়ে আবার একটা আলি-শান বাড়ি কিনি। এর মধ্যে আমাদের দুটি কন্যা সন্তান হয়। বছর সাতেক পরে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথেও আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সে মেয়ে দুটোকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। কোর্ট থেকে সেপারেসন ওয়ারেন্ট নিয়ে সে বাড়িটা পানির দামে নিলামে বিক্রি করে দেয়। তখন বাড়ি কেনা বেচার বাজারে ধ্বস নেমেছে। তাই বাড়ীর সব দেনা পরিশোধ না করতে না পারায় ব্যাংক আমাকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। শেষমেশ আমার চাকরীটাও চলে যায়।

তখন আমার মাথায় এবনরমালিটি দেখা দেয়। বন্ধুরা ধরে নিয়ে আমাকে রিহাবে ভর্তি করে দেয়। কয়েকবছর পরে আমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাই। মেয়ে দুটির কথা খুব মনে পড়তে থাকে। অনেক খোঁজ খবর করে জানতে পারি মেয়ে দুটিকে ফেলে রেখে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী আবারও বিয়ে করে। একটি মেয়ে বয় ফ্রেন্ডের সাথে আমেরিকা চলে গেছে। অন্য মেয়েটাকে আমার এক বন্ধু সিডনিতে দেখেছে।

আমি মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

তুমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার কাজ শুরু করলে না কেন?

ব্যাংকের দেনা দিনে দিনে বেড়ে অনেক গুন হয়েছে। আর দেউলিয়া লোককে চাকুরী দেবে কে বলো?

সিডনিতে এসে রাতে শহরের বাইরে কোন রাস্তায় কিংবা নিরিবিলি পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমাই। আর সকাল হলে শহরে আশেপাশে মেয়েটির খোঁজে বেড়িয়ে পড়ি। তারপর সে তার মেয়েটির ছোটবেলার একটি ছবি বুকপকেট থেকে বের করে দেখায়। আমি অবাক দৃষ্টিতে বললাম,

এখন তোমার মেয়ের চেহারা অনেক বদলেছে। তুমি তাকে দেখলে এখন চিনতে পারবে?

যাকে দেখতে আমার মেয়ে বলে মনে হয়, তাকেই এই ছবিটা বের করে দেখাই।

বলতে বলতে মাইকেলের চোখের দু’কোন ভিজে উঠলো। তখন এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাকে উঠে কাজে যেতে হবে। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার আগে বেঞ্চে ঘুমন্ত অবস্থায় একটি ছবি তুলেছি তাকে বললাম। তার মধ্যে কোন ভাবাবেগ হল না।

শপিং মলে ঢুকে অনেক অল্পবয়সী তরুণীদের ফুলের তোড়া কিনতে দেখলাম। কল্পনায় দেখলাম একজন অতি সুন্দরী তরুণী ঘুমন্ত মাইকেলের বেঞ্চের সামনে ফুল হাতে করে সন্তর্পণে দাঁড়িয়ে আছে। যেন সে তার ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষায় আছে- আজকের এই ভ্যালেন্টাইন ডে’ তে।

নাইম আবদুল্লাহ
সিডনি প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com