দাসত্বের জীবন থেকে বাঁচার আকুতি পরবাসীদের

রবিবার, ০৭ জুন ২০২০ | ১:০৫ পূর্বাহ্ণ | 237 বার

দাসত্বের জীবন থেকে বাঁচার আকুতি পরবাসীদের

যে শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে পুষ্ট রেমিট্যান্স, সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, সেই প্রবাসীকর্মীদের খোঁজ রাখেন না কেউ। একটু সুখের আশায় পরিবার-পরিজন ফেলে সর্বস্ব ব্যয় করে তারা খেটে মরছেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে। সুখের দেখা অনেকের মিলেছে, অনেকের মেলেনি।

দুর্ভাগ্য যারা তারা পড়েছেন দালালের খপ্পরে। কর্মহীন হয়ে বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে কাটছে তাদের দাসত্বের জীবন। বাংলাদেশ থেকেই শুরু হয় দালালদের শোষণ। সম্প্রতি এর ভয়াবহ চিত্র মিলেছে লিবিয়ায় নির্মমভাবে নিহত হওয়া ২৬ বাংলাদেশির করুণ পরিণতির খবরে। যা দেশে-বিদেশে এখন আলোচিত হচ্ছে।

গত ২৮ মে লিবিয়ায় মিজদাহ শহরে নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ২৬ বাংলাদেশি নিহত এবং ১১ বাংলাদেশি মারাত্মকভাব আহত হন। বর্বরোচিত ওই ঘটনায় মূল উৎঘাটন করতে গিয়ে দেখা যায়, অবৈধভাবে ইউরোপে গমনের জন্য বিভিন্ন দালালচক্র ইউরোপে উন্নত জীবনের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিনিয়ত অসহায় বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে নৌ-পথ ও দুর্গম মরুপথ দিয়ে প্রেরণ করে আসছে।

এই অবৈধ অভিবাসীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জিম্মি করে প্রতিনিয়ত মুক্তিপণদাবি এবং শারীরিক নির্যাতন করে আসছে। পরবর্তীতে র‌্যাবের ছায়া তদন্তে বেরিয়ে আসে মানবপাচারের সাথে জড়িত চক্রটির অন্যতম হোতা হাজী কামালের নাম। রাজধানীর গুলশান শাহজাদপুর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

নানা প্রলোভন আর আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখিয়ে মালয়েশিয়ায় অসহায় বাংলাদেশিদের নিয়েও ক্রীতদাস বানানো হচ্ছে। এর পেছনেও রয়েছে সক্রিয় দালালচক্র। বিগত জিটুজি প্লাসে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে দেশি রিক্রুটিং এজেন্সি সরকারের বেধে দেয়া ব্যয়ের চেয়ে শ্রমিকপ্রতি আদায় করেছে তিন থেকে শুরু করে সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত। শুরুতেই একজন শ্রমিকের গচ্চা যায় তিন থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা। এরপর মালয়েশিয়ায় নির্দিষ্ট কোম্পানিতে পৌঁছেই পড়েন জিম্মি-বাণিজ্যের কবলে।

পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে কাজ না দিয়ে বসিয়ে রেখে দাবি করা হয় বাড়তি টাকা বা বেতনের অংশ। সেটা দিলেই কাজ মেলে। এখানেও আরেক কারসাজি। ওই শ্রমিক যে কোম্পানিতে এসেছেন, হয়তো তাদের কোনো কর্মক্ষেত্রই নেই; নামমাত্র দালালি কোম্পানি। তারা তখন শ্রমিককে অন্যত্র চাকরিতে দেয় চুক্তির চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি বেতনে এবং মাসশেষে বাড়তি টাকাটা নিজেরা পকেটস্থ করে।

দু-চার মাস পর সেই ভাড়া দেয়া শ্রমিককে চুক্তির প্রাপ্য টাকাও দেয়া হয় না; কেটে রাখা হয় ঋণ, থাকা-খাওয়াসহ নানা অজুহাতে। চুক্তি অনুযায়ী যা করার কথা নয়। এভাবেই চলছে শোষণ।

সরেজমিন দেখা যায়, এমসিসি ইস্ট মালয়েশিয়া এসডি এন বিএইচডির সাপ্লাইয়ার কোম্পানির সেরি সারডাং গোডাউনে পড়ে রয়েছেন ভুক্তভোগী প্রায় ৭০ বাংলাদেশি কর্মী। তারা জানান, বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি ইউনিক ইস্টার্ন, রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, কাতারসিস, সানজারিনের মাধ্যমে মালয়েশিয়া আসেন। মানুষের বসবাসের মতো ওই গোডাউনে নেই কোনো ব্যবস্থা। অপরিষ্কার ও নোঙরা পরিবেশ দেখলেই গা-শিউরে উঠবে। গাদাগাদি করে ৭০ বাংলাদেশি সেখানে রয়েছেন। সবার মুখে বিষণ্নতার ছাপ। কেউ ভয়ে কথা বলতে রাজি নন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বললেন, কী আর বলব ভাই। আপনি এসেছেন, কুশল বিনিময় করে চলে যান। সাপ্লাইয়ার কোম্পানির লোকজন রয়েছে। কিছু বললে আপনি যাওয়ার পরই আমাদের ওপর চলবে শারীরিক নির্যাতন। যারাই প্রতিবাদ করেছে তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন হয়েছে। প্রতিবাদ করায় কয়েকজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তারা কোথায় আছে, কেউ জানে না। এমনকি কোম্পানিও তাদের খোঁজ নেয় না। আমরা গোডাউনে পড়ে রয়েছি বেঁচে থাকার তাগিদে।

‘টানা লকডাউনের মধ্যে সাপ্লাইয়ার কোম্পানির লোক এসে ১০০ রিঙিত করে দিছিল, পরে আর দেয়নি। যোগাযোগ করলে গালিগালাজ করে। বাড়ি থেকে টাকা আনার কথা বলে। টানা দুই মাস ধরে আমরা কষ্টে রয়েছি। এমন পরিস্থিতির কথা জানাতে কয়েকদিন হাইকমিশনের টেলিফোন নম্বরে ফোন করেছি। কেউ রিসিভ করেনি।’

দালালের প্রলোভনে পড়ে স্থানীয় এজেন্সির মাধ্যমে কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্মম নির্যাতনের শিকার তারা। দালালের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে তামিল গ্যাং দিয়ে চলে শারীরিক নির্যাতন। কখনও কখনও এক-দুই মাস কাজ করিয়ে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিচ্ছে একশ্রেণির বাংলাদেশি দালাল।

পটুয়াখালীর মরিচ বুনিয়া গ্রামের মৃত আব্দুল ওয়াহাব ফকিরের ছেলে রাসেল মাহমুদ (২৮)। অভাব-অনটন থেকে মুক্তি পেতে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে একই গ্রামের দালাল মজিবুরের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান।

২০১৭ সালের ১১ জুন ঢাকার ইউনিক ইস্টার্ন ওভার্সিজের মাধ্যমে সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়ায় আসেন রাসেল। রংপুর জেলার পীরগাছা থানার গগুয়া গ্রামের মৃত মজিবুর রহমানের ছেলে ইসলাম মো. সাইদুল ২০১৮ সালের নভেম্বরে একই কোম্পানির মাধ্যমে দালাল মজিবুরের হাত ধরে ইউনিক ইস্টার্ন এজেন্সির মাধ্যমে সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া আসেন।

রাসেল মালয়েশিয়া আসার পর ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত মাত্র সাত মাস কাজ করার সুযোগ পান। বাকি দিনগুলো বিভিন্ন গোডাউনে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ায় এসে একই অবস্থায় পড়েন সাইদুলও।

শুধু সাইদুল আর রাসেল নয় তাদের মতো আরও প্রায় ৭০ জন স্বপ্নবাজ তরুণও নির্যাতনের শিকার। কথায় আছে, অভাগা যেদিকে যায় নদী শুকিয়ে যায়। তাদের অবস্থাও তেমন। মালয়েশিয়া আসার পর ভালো কাজ পাওয়া তো দূরের কথা, বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন স্বপ্নবাজ এই তরুণরা।

এভাবে পদে পদে শোষিত হয়ে দিশেহারা অনেকে রাস্তা খোঁজেন পালানোর। মূল কোম্পানি এ অবস্থা টের পেয়ে তাকে নিয়ে শুরু করে বেচা-কেনার খেলা। হাত-বদল হতে হতে নিঃশেষ হয়ে একসময় পালিয়ে যান, কিন্তু গিয়ে পড়েন আরেক ফাঁদে। হয়ে যান ‘অবৈধ শ্রমিক’। স্বাধীনভাবে চাকরি খুঁজে নিয়ে লুকিয়ে বা চুরি করে থাকতে হয় তাদের। এমন সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

মালিক ভালো হলে বেতন থেকে কোনো কাটাকাটি নেই। ধারদেনা কিছু শোধ করতে পারেন, দেশের বাড়িতেও কিছু পাঠাতে পারেন। কিন্তু চোরের মতো আর কত? ধরপাকড়, পুলিশের তাড়া তো আছেই। এভাবে একসময় এসে পড়ে বৈধ হওয়ার সুযোগ।

এখানেও ফাঁদ পেতে বসে থাকে নামসর্বস্ব কিছু কোম্পানির বৈধকরণ-নবায়নের ফাঁদ। এখানে গুনতে হয় সরকার নির্ধারিত বৈধকরণ ফির চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ-চারগুণ টাকা। বছর শেষে আবার আসে ভিসা নবায়নের পালা। সেখানেও একই অবস্থা, দিতে হয় কয়েকগুণ বেশি টাকা। এতেও শেষ নয়। ওই কাগজে কোম্পানিগুলোও শ্রমিকদের নিয়ে শুরু করে বেচাকেনা ও ভাড়া খাটানোর খেলা।

এবারও শ্রমিকদের প্রকৃত পাওনা থেকে কমিশনের নামে টাকা চলে যায় দালালদের পকেটে। এভাবে চলে বছরের পর বছর।

এসব মজুরি-খোয়ানো অসহায় মানুষগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো অভিযোগ করেন না। যেহেতু তাদের কাছে কোনো প্রমাণ থাকে না। আর সমাজের মুখোশধারী এই ছদ্মবেশিদের সঙ্গে পেরে উঠবেন না এমন ভয়ও সর্বক্ষণ তাদের তাড়া করে ফেরে।

সমাজের অতি সাধারণ আর অবস্থার ফেরে সবচেয়ে অসহায় আর বিপন্ন এই মানুষগুলো বিচার দিয়ে রেখেছেন উপরওয়ালার কাছে। তিনি ছাড়া বিদেশ-বিভুঁইয়ে তাদের আর কেই-বা আছে!

মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন ক্যারাম এশিয়ার সাবেক সমন্বয়কারী হারুন-উর রশিদ। তারও ভাষ্য, দালালদের প্রতারণার কারণে অনেক কারখানায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা ক্রীতদাসের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। দালাল কোম্পানিগুলো অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেশি বেতনে চুক্তি করে শ্রমিকদের কম বেতন ধরিয়ে দিয়ে বাকিটা আত্মসাৎ করে; আবার সেই কম বেতন থেকেও নানা ছুতায় টাকা কেটে নেয়া হয়। অনেক যুবক বিদেশ গিয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সরকারের উচিত এসব দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com