ইয়েমেন কি আগ্রাসী সৌদি জোটের ‘ভিয়েতনাম’ হচ্ছে?

রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ১১:০০ অপরাহ্ণ | 224 বার

ইয়েমেন কি আগ্রাসী সৌদি জোটের ‘ভিয়েতনাম’ হচ্ছে?

ইয়েমেনে সৌদি জোটের আগ্রাসন আবারও বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। মনে হচ্ছে সৌদি জোটের ৫ বছরের চলমান আগ্রাসনের সমীকরণ এবার পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে এবং তা ক্রমেই আগ্রাসীদের চূড়ান্ত পরাজয়কে অনিবার্য করে তুলবে।

এ বছর তথা আগ্রাসনের পঞ্চম বছরের শুরুর দিকে সৌদি রাজপরিবার নিয়ন্ত্রিত তেল-কোম্পানি আরামকোর স্থাপনায় ইয়েমেনি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ছিল আগ্রাসী সৌদি জোটের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় । এ হামলার জের ধরেই ভীত-সন্ত্রস্ত সৌদি সরকার সম্প্রতি মক্কায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। এই আরব শীর্ষ বৈঠকে রাজা সালমান ওই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা উল্লেখ করেন।

এ ছাড়াও গত এক সপ্তায় দক্ষিণ সৌদি আরবের নাজরান প্রদেশের ২০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে ইয়েমেনি সেনারা। আগ্রাসীদের হতচকিত করে-দেয়া এক আকস্মিক সিরিজ-অভিযানে ২০০’রও বেশি সৌদির অনুচর সেনা হতাহত হয় ইয়েমেনিদের হাতে। তারা বহু ভাড়াটে সেনাকে বন্দিও করে।

ইয়েমেনি প্রতিরোধ-যোদ্ধারা ইদানীং সীমান্তবর্তী সৌদি নাজরান ও জিযান প্রদেশে হামলা জোরদার করেছে অপেক্ষাকৃত সহজ টার্গেট হিসেবে। ইয়েমেনের জনপ্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন আনসারুল্লাহর নেতা সাইয়্যেদ আবদুল মালিক হুথি সৌদি জোটের আগ্রাসন মোকাবেলায় প্রতিরোধ যুদ্ধের পঞ্চম বছরকে ‘বিজয়ের বছর’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।

ইয়েমেনিরা এখন প্রতিরক্ষার পাশাপাশি আক্রমণের কৌশলও জোরদার করেছে। ফলে বদলে যাচ্ছে যুদ্ধের সমীকরণ।
এদিকে ইয়েমেনি সৌদি-জোটের গণহত্যা, অবরোধ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্ব-জনমতের ব্যাপক নিন্দা ও চাপ সত্ত্বেও এই জোটের প্রতি পাশ্চাত্যের সর্বাত্মক সহায়তা কমেনি বরং বেড়েছে। সম্প্রতি এক রিপোর্টে দেখা গেছে, গত বছরে সৌদির কাছে ফ্রান্সের অস্ত্র বিক্রি ৫০ শতাংশ বেড়েছে।

মার্কিন সরকার ও ফ্রান্সসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো ইয়েমেনে অবরোধ ও আগ্রাসনের কারণে সৃষ্ট মানবীয় বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে সৌদি জোটের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ হওয়া উচিত বা বন্ধ করা হচ্ছে বলে প্রচারণা চালালেও বাস্তবে সৌদি সরকার ও তার মিত্রদের কাছে পশ্চিমা অস্ত্র বিক্রি ক্রমেই বাড়ছে।

ইয়েমেনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে ৫ বছর ধরে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে পশ্চিমা মদদপুষ্ট সৌদি-জোট। যে সৌদি আরবে গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা ও ধর্মীয়-স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই এবং মানবাধিকার বলতেও বাস্তবে তেমন কিছুই নেই সেই রাজতান্ত্রিক সৌদি সরকার ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ থেকে দারিদ্র-পীড়িত ইয়েমেনে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে!

ইয়েমেন-বিরোধী সৌদি জোটের শরিক আরব দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, সুদান ও কয়েকটি ক্ষুদ্র দেশ। ইয়েমেনের ওপর এই দেশগুলোসহ গোটা পাশ্চাত্য ও তাদের মিত্র দেশগুলো চাপিয়ে দিয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এমনকি তারা জাতিগুলোর অধিকার রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতিসংঘকেও ব্যবহার করছে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে! ইয়েমেনের বিপ্লবী সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ কার্যকরের নামে এইসব শক্তি ইয়েমেনের যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ-কবলিত অঞ্চলের জনগণের কাছে খাদ্য ও জরুরি ত্রাণ সরবরাহেও বাধা দিচ্ছে।

ইয়েমেনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের কাছে পশ্চিমা দেশগুলো প্রতি বছর বিক্রি করছে হাজার হাজার কোটি ডলারের গণ-বিধ্বংসী ও এমনকি নানা ধরনের নিষিদ্ধ অস্ত্র। এইসব অস্ত্রের নির্বিচার প্রয়োগে হতাহত হয়েছে হাজার হাজার বেসামরিক ইয়েমেনি নাগরিক। হতাহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। বিয়ে-বাড়ীর জনসমাবেশ,শোক-সমাবেশ ও শিশুদের স্কুল-বাসও রেহাই পাচ্ছে না নির্বিচার সৌদি গণহত্যার মেশিন হিসেবে ব্যবহৃত বিমান হামলা থেকে।

ইয়েমেনের বিপুল সংখ্যক শিশু হত্যায় সৌদি রেকর্ডের কারণে জাতিসংঘ সৌদি সরকারকেও শিশু-ঘাতক সরকারগুলোর কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল। কিন্তু সৌদি সরকার জাতিসংঘকে চাঁদা ও সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়ায় জাতিসংঘ শিশু-ঘাতক সরকারগুলোর তালিকা থেকে সৌদি সরকারের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। একই ধরনের কারণে জাতিসংঘ দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলকেও শিশু-ঘাতক সরকারগুলোর তালিকাভুক্ত করতে সাহস করছে না।

সৌদি জোটের নির্বিচার বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে ইয়েমেনের বেশিরভাগ জরুরি বেসামরিক অবকাঠামো যার মধ্যে রয়েছে কোনো কোনো বিমানবন্দর, আবাসিক বাড়ী-ঘর, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, কল-কারখানা, খাদ্য-গুদাম, বাজার, মসজিদ, বিদ্যুৎ ও পানি-সরবরাহ কেন্দ্রের মত জরুরি নানা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা।

আগ্রাসন ও অবরোধের শিকার ইয়েমেনে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ক্ষুধা ও অপুষ্টির মত নানা প্রাণঘাতী সংকট। জাতিসংঘসহ নানা সংস্থার হিসাবমতে প্রায় প্রতি মিনিটে মারা যাচ্ছে অপুষ্টি ও কলেরা রোগসহ নানা রোগের শিকার একটি করে শিশু। বাড়ি-ঘরহারা আশ্রয়হীন শরণার্থীর সংখ্যাও হবে অন্তত অর্ধ-কোটি। অন্যায়-অবরোধের শিকার দরিদ্র এই দেশটির প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নিয়মিত খাদ্য ও জরুরি ওষুধ পাচ্ছে না।

ইয়েমেনে সৌদি আরবের আগ্রাসনে সর্বাত্মক মদদ যোগাচ্ছে দখলদার ইহুদিবাদীইসরাইল,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। সৌদি আরবকে সামরিক,লজিস্টিক, রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা তথ্যসহ সর্বাত্মক সমর্থন, সাহায্য ও সহযোগিতা করছে নব্য-উপনিবেশবাদী এই সরকারগুলো। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন আগ্রাসী জোটের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবেও অংশগ্রহণ করছে।

সম্প্রতি মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস ইয়েমেনের নিরীহ জনগণকে হত্যায় আমেরিকার সরাসরি ভূমিকা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। দৈনিকটি সৌদি আরবের কাছে আমেরিকার বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র বিক্রির কথা উল্লেখ করে লিখেছে, ইয়েমেনে চালানো গণহত্যায় আমেরিকার হাত থাকার বিষয়টি এখন সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।

নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত দৈনিকটি এক নিবন্ধে আরো লিখেছে, আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ইয়েমেনে সামরিক আগ্রাসন চালানো সৌদি আরবের পক্ষে সম্ভব নয়। নিবন্ধে বলা হয়েছে, মার্কিন সরকার কয়েক দশক ধরে সমরাস্ত্র বিক্রির জন্য সম্পদশালী কোনো দেশকে বেছে নিচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে ইয়েমেনের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সৌদি আরবের চালানো গণহত্যা আমেরিকার সে নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে, সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট বিমান হামলা চালানোর ক্ষেত্রে বেসামরিক ও সামরিক এলাকাকে গুলিয়ে ফেলছে এবং তারা স্কুল ও হাসপাতালসহ বেসামরিক স্থাপনাগুলোয় নির্বিচারে বোমা হামলা চালাচ্ছে।

একইভাবে ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা, ইতালি, জার্মানি ও আরও কয়েকটি পশ্চিমা দেশের মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে আগ্রাসী সৌদি বাহিনী।

সূত্র: দশ দিগন্ত

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০ 

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com