কয়লা তুলেই জীবন পার

বৃহস্পতিবার, ১২ মার্চ ২০২০ | ১০:৩৭ অপরাহ্ণ | 276 বার

কয়লা তুলেই জীবন পার

নেত্রকোনার দুর্গাপুরের সহস্রাধিক নারী এবং পুরুষ শ্রমিক কয়লা তুলেই জীবন-জীবিকা চালান। পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরীর ধূ-ধূ বালির নিচে চাপা পড়ে থাকা এসব জৈব কয়লা এখন তাদের কাছে ‘কালোসোনা’। কিন্তু তাতে তাদের জীবন বদলায় না।

নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা সোমেশ্বরী নদী থেকে কয়লা তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন শ্রমিকরা। ”সকাল থাইক্যা সইন্ধ্যা পর্যন্ত কয়লা তুলি। সারাদিনে ২৫ থাইক্যা ৩০ কেজি পর্যন্ত কয়লা তুলতাম পারি। আর ভাগ্য ভালা থাকলে এক মণও পাই। ৩০০ থাইক্যা ৩৫০ টেহা পর্যন্ত মণ দরে বেচতাম পারি। এইডাই আমার সংসার চালানির উপায়।” কথাগুলো দুর্গাপুরের বালিকান্দি গ্রামের কয়লা শ্রমিক কুলসুমা বেগমের (৬০)। প্রায় দশ বছর ধরে এ কাজ করছেন তিনি।

শুধু কুলসুমা নন, তার মতো দুর্গাপুরের আরও সহস্রাধিক নারী এবং পুরুষ শ্রমিক কয়লা তুলেই জীবন-জীবিকা চালান। পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরীর ধূ-ধূ বালির নিচে চাপা পড়ে থাকা এসব জৈব কয়লা এখন তাদের কাছে ‘কালোসোনা’। যদিও কয়লা তুলতে গিয়ে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তাদের নিজের জীবনও প্রায় কয়লা হয়ে যায়।

নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা এক পাহাড়ি নদীর নাম ‘সোমেশ্বরী’। মেঘালয়ের পাহাড়কুঞ্জ থেকে নেমে আসা এ নদী দিয়ে বর্ষায় নিম্নাঞ্চলের দিকে পাহাড়ি ঢল প্রবাহিত হয়। ঢলের সঙ্গে বয়ে আসে বিপুল পরিমাণ সিলিকা বালি ও প্রাকৃতিক কয়লা। নদীর তলদেশে বালির পরতে পরতে (স্তরে) এসব কয়লা লুকিয়ে থাকে। খুব কষ্টকর প্রক্রিয়ায় এসব কয়লা সংগ্রহ করেন স্থানীয় শ্রমিকরা। তবে বর্ষা মৌসুমে ভরা নদীতে কয়লা তোলা যায় না। পানি যখন কমে আসে- তখন কয়লা তুলতে হয়।

বালিকান্দি গ্রামের আরেক কয়লা শ্রমিক ফাতেমা বেগম বলেন, ”নদীর সবখানও কয়লা থাহে না। অনুমানের ওপর কাম করতে অয়। মাঝে মধ্যে চার-পাঁচ ফুট বালু খুঁদলেও (খুড়লে) কয়লার উদ্দিশ (সন্ধান) পাওন যায় না। আবার কয়লার সন্ধান পাইলে বালুর পরত (স্তর) থাইক্যা একটু একটু কইরা বাইছ্যা বাইছ্যা (বেছে বেছে) তুলন লাগে।”

দিনের যে কোনো সময় সোমেশ্বরীর চরে গেলেই দেখা মিলবে কয়লা তোলার দৃশ্য। সকাল ১০টার মধ্যেই বালি খোঁড়ার কাজে লেগে যান স্থানীয় শ্রমিকরা। নারীদের পাশাপাশি পুরুষ এবং দরিদ্র শিশুরাও কয়লা তুলতে আসে সেখানে। কয়লা আহরণের সরঞ্জাম হিসাবে লাগে কোঁদাল, থালা অথবা জালি ও ছাকনি। নারী শ্রমিকরা শুকনো চর থেকে বালি খুঁড়ে কয়লা তোলেন।

প্রথমে তারা কোঁদাল দিয়ে গর্ত করেন। এরপর কয়লার সন্ধান পেলে থালার সাহায্যে অল্প অল্প করে তুলে আনেন। আর পুরুষরা কয়লা সংগ্রহ করেন পানির নিচ থেকে জালি বা ছাকনি দিয়ে। অনেকে নৌকাও নিয়ে যান। সারাদিন কয়লা তোলার পর বিকেলে তা নদীর পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করেন। এরপর পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন।

সোমেশ্বরীর কয়লা আহরণকে কেন্দ্র করে নদীর চরেই গড়ে উঠেছে কয়লার বাজার। প্রতিদিন দুপুর গড়ালেই সেখানে পাইকাররা ভিড় জমান। শ্রমিকদের কাছ থেকে তারা সরাসরি কয়লা কেনেন। এরপর তারা তা বিক্রি করেন ইটভাঁটা মালিকদের কাছে। নেত্রকোনা ছাড়াও ময়মনসিংহ, শেরপুর, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ইটভাঁটার মালিকরা দুর্গাপুর থেকে কয়লা সংগ্রহ করেন। এসব কয়লা ইটের ভাঁটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি হিসেবে সোমেশ্বরীর কয়লা খুব উৎকৃষ্ট বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

কয়েকজন নারী কয়লা শ্রমিক জানান, সারাদিনে একজন ২৫ কেজি থেকে সর্বোচ্চ এক মণ পর্যন্ত কয়লা তুলতে পারেন। প্রতি এক মণের জন্য তারা পান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। অন্যদিকে পুরুষ শ্রমিকরা জালি বা ছাকনির সাহায্যে যে কয়লা তোলেন- তার মান একটু ভালো। তাই দামও একটু বেশি। প্রতি মণ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।

স্থানীয় কয়লা ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়া বলেন, ইট ভাটার মালিকরা কয়লা কেনেন টন হিসেবে। মাণ অনুযায়ী এক টনের বিক্রয়মূল্য সাত থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা। বর্ষা ছাড়া বছরের প্রায় ১০ মাসই কয়লা তোলার কাজ চলে সোমেশ্বরীতে। তবে অভিযোগ রয়েছে, দুর্গাপুরে কয়লার বাজারটি নিয়ন্ত্রণ করে একটি সংঘবব্ধ সিন্ডিকেট। এরা নিজেদের ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করে। অর্থাৎ তারা যে দাম দেয়- শ্রমিকদের সে দামেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কয়লার বাজারে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলে জানান কয়লা শ্রমিকরা।

জাহাঙ্গীর নামে এক কয়লা শ্রমিক এ প্রতিবেদকে বলেন, ”স্থানীয় প্রশাসন একটু নজরদারি করলে আমরা ন্যায্য মূল্য পেতাম।”

এদিকে কয়লা তুলে অনেক নারী-পুরুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করলেও কয়লা তুলতে গিয়ে তাদের বহু সমস্যা ভোগ করতে হয়। সারাদিন রোদে পুড়ে তাদের শরীরও কয়লার মতো অঙ্গার হয়ে যায়। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জ্বর, সর্দি-কাশিসহ নানা ধরনের রোগ-বালাই দেখা দেয়। আর কয়লা তোলার সময় সিলিকা বালির ঘষায় হাতে-পায়ে মারাত্মক ক্ষত হয়।

দেখা গেছে, কুলসুমা-ফাতেমার মতো আরও অনেকের হাত-পায়ে রীতিমতো ঘা হয়ে গেছে। হুইলিস নকরেক নামে এক আদিবাসী নারীকে দেখা গেছে, তার হাতে ও পায়ে মারাত্মক ক্ষত। ক্ষতস্থানে পলিথিন পেচিয়ে কয়লা তুলছেন তিনি।

কথা প্রসঙ্গে বলেন, ”পেট তো আর কোনো কিছু মানে না। তাই বইসা থাকার একটুও সুযোগ নাই।” এক কথায় সোমেশ্বরীর প্রাকৃতিক কয়লা এখন তাদের কাছে ‘কালোসোনা’। এই ‘কালোসোনাই’ বাঁচিয়ে রাখছে তাদের জীবন।

দূর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা খানম বলেন, খোঁজ নিয়ে কয়লা শ্রমিকদের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com