ভিনদেশি ওরা তিনজন…

সোমবার, ১৭ মার্চ ২০১৪ | ১২:১৬ অপরাহ্ণ | 540 বার

ভিনদেশি ওরা তিনজন…

কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশটা বছর কেটে গেলো। মামা বাড়ীর নাদের আলী বলেছিল দাদা ঠাকুর বড় হ… না এই বিখ্যাত কবিতার পংতিমালা গুলো ভিনদেশে জন্মগ্রহণকারী তিনজন মহীয়সী মানুষ পড়েননি। তবে তারা কথা রেখেছে। দীর্ঘ তেত্রিশটা বছর যাবত বসবাস করছে বাংলাদেশের মতো একটা অনুন্নত দেশে তাদের সমস্ত ভোগ বিলাসিতা উপেক্ষা করে। এই তিন জন হল ভেলেরি টেলর, ফ্রেডরিক হাইড এবং ডাঃ এডরিক বাকের। ডঃ এডরিক বাকেরঃ নিউজিল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী এই ডাঃ এডরিক বাকের ১৯৬০ সনে ডাক্তারি বিষয়ে পড়াশুনা শেষ করেন। ঐ সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের দামামা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছিলো। আর তক্ষুনি একমূহুর্ত দেরি না করে যুদ্ধাহত সাধারণ মানুষদের সেবা প্রদানের জন্য ভিয়েতনাম পাড়ি জমান এই ডাক্তার। এরপর পাপুয়া নিউগিনি, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে আর্ত মানবতার দেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশে আসেন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের জন্য কার্যকর একটি স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করা। আর সেই থেকে তিলে তিলে গড়ে তোলেন বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে “খাইল কুরি হেলথ সেন্টার”। যেখানে তিনি দীর্ঘ তেত্রিশটা বছর কাটিয়েছেন বিদ্যুৎ বিহীন, চলাফেরা করেছেন বাইসাইকেল চালিয়ে, বসবাস করেছেন মাটির ঘড়ে। এই হেলথ সেন্টারে বছরে বিয়াল্লিশ হাজারেরও বেশি রোগী সেবা পেয়ে আসছেন। শুধু স্বাস্থ্য সেবাই নয়, গড়ে তুলেছেন শিক্ষার জন্য স্কুল, সচেতনতা গড়ে তুলেছেন পুষ্টিকর খাবারের উপর। আর এই সকল সেবা প্রদানের মুলে যিনি তার নাম ডাঃ এডরিক বাকের। প্রতিষ্ঠানটি চালানোর জন্য নির্দ্বিধায় আর্থিক সহায়তা চেয়েছেন উন্নত দেশের ধনী মানুষদের কাছে। ফ্রেডরিক হ্যারল্ড হাইড: ফ্রেডরিক হ্যারল্ড হাইড যাকে আমরা ফ্রেড হিসাবেই চিনি। খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান সাদা মনের সাদা মানুষ। যিনি তার জীবনের তেত্রিশটি বছর কাটিয়ে দিয়েছন বাংলাদেশের সেই প্রত্যন্ত অঞ্চল ভোলার চর ফ্যাশনে। গড়ে তুলেছেন… প্রায় ৪০ টি স্কুল। আর এই স্কুলে শিক্ষা নিচ্ছে প্রায় বার হাজার শিক্ষার্থী। তারা হত দরিদ্র। ফ্রেডের এই স্কুল না থাকলে তাদের ভাগ্যে হয়ত কোনদিন স্কুলে যাওয়া হত না। ফ্রেডের বয়স এখন প্রায় নব্বই। এই বয়সেও সে বাংলাদেশে বছরের অর্ধেক সময় কাটায়। আমার সঙ্গে ফ্রেডের পরিচয় ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। আমি মাত্র বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসেছি। বাংলাদেশে ভ্রমণের সময় আমি নিজ উদ্যোগে আমার এলাকায় চরাঞ্চলে একটি স্কুল স্থাপন করি। সিডনিতে ফিরে এ বিষয়ে কিছু লেখালেখিও করি । আমি তখন বেশ উত্তেজিত। ঠিক সেই সময় ফ্রেডের একটি ফোন কল পাই। ফ্রেড তার নিজের পরিচয় দিয়ে আমাকে প্রশ্ন করেন আমি কিভাবে এই ধরণের প্রকল্পের ব্যাপারে উদ্ভুদ্দ হলাম। আমি তাকে বুঝালাম এই স্কুল স্থাপন আমার নিছক ব্যক্তিগত উদ্যোগে, এলাকার হত দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার কথা চিন্তা করেই আমার এই উদ্যোগ। ফ্রেড তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা আমাকে জানালো। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কথা শেষ করি। এর পর থেকে ফ্রেডের সঙ্গে আমার আর কোন যোগাযোগ হয় নাই। আমার সেই স্থাপন করা স্কুলের আজ তিন বছর হয়ে গেল। দ্বিতীয় স্কুলের পরিকল্পনা আর নিতে পারি নাই। অথচ এই বুড়ো ফ্রেড ৪০ টি স্কুল ইতিমধ্যেই স্থাপন করে ফেলেছে। এ যেন তাঁর নেশা। ফ্রেড তোমার ঋণ আমারা কোনদিন শোধ করতে পারবো না। ভেলরই টেলর: তারুণ্যে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এই দেশ ঘুরে গিয়েছিলেন ৬৯ সনে।তারপর বোকা মহিলাটি আবার এদেশে ফিরে এসেছিলেন ৭২ সালে।রক্তাক্ত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের ফিজিওথেরাপি দিতে ।কেউ তাকে ডেকে আনেনি।তবু তিনি চলে এসেছিলেন।পাগলী আর ফিরে যাননি। ৭৯ সনে অনেক চেয়ে চিন্তে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিত্যক্ত গুদাম ঘরখানি পেলেন।ঝেড়ে-মুছে শুরু করলেন একটা ছোট,খুবই ছোট ফিজিওথেরাপির স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।সি.আর.পি। তারপর সেই বোকা মেয়েটি তার সীমিত সাধ্যে একখান সাইকেল চেপে ঘুরতে লাগলেন দুয়ারে দুয়ারে।মাথা নিচু করলেন,হাত পাতলেন,অপমানিত হলেন,গঞ্জনা সইলেন,হতাশ হলেন তবু হাল ছাড়লেন না।নিজের জন্য নয়,সেই বোকা মানুষটি সব করলেন আমাদের জন্য।মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়ে থাকা কিশোরী,বাবার কাঁধে ভর করে চলা চলৎ শক্তিহীন তরুণ,বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়ে পঙ্গু হওয়া পরিবারের একমাত্র লোকটা…তাদের জন্য কেঁেদ ফিরতে লাগলেন …।তারপর এখানে সেখানে ভাড়া বাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান হলেন,তবু তার মানব সেবা শেষ হলো না। এভাবেই একদিন মহীরুহ হলো তার সংগঠনটি।সি.আর.পি পরিণত হলো দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠানে যেখানে ঠাই হলো মেরুদণ্ড ভাঙা অসহায় মানুষের,ক্র্যাচে ভর করে চলা,বুকে হেটে চলা,উবু হয়ে চলা,গড়িয়ে চলা অজস্র মানুষের।আমার দেশের মানুষের। চলার পথে পিছু ফিরে একদিন সেই পাগলী দেখলেন পাগলী মেয়ে থেকে তিনি পাগলী প্রৌড়াতে রূপান্তরিত হয়েছেন,কিন্তু জীবনের পথে হয়নি সংসার…। দুইটি মেয়েকে দত্তক নিলেন তিনি,পঙ্গুমেয়ে,পক্ষাঘাতগ্রস্ত মেয়ে।আর সবার মতোই তাদেরকে কাজ শেখালেন তিনি,তারপর চাকরি দিলেন সি.আর.পিতে। এদেশে এন.জি.ও বলুন, কনসালটেন্সি ফার্ম বলুন আর যাই বলুন,সংগঠনের বড়ো কর্তার কিন্তু বেতনটা হয় ডলারে।টাকার অংকে সেই বেতন শুনে আমরা সাধারণ মানুষ ভীমরই খাই।আমাদের কল্পনাতেও কোনদিন এতো টাকা ধরা দেয় না। এই বিদেশিনী পাগলি কতো বেতন নেন জানেন?সাড়ে সাত হাজার ! না ডলার নয়,টাকা!! মাত্র সাড়ে সাত হাজার টাকায় চলে তার সংসার।বনানী গুলশানের যেকোনো সাহেবের ড্রাইভারের বেতন থেকে দেড় হাজার টাকা কম! আমরা যখন বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের এবং পরিবারের আরাম আয়েশের কথা ভেবে বিদেশে পাড়ি জমাই, বিপরীতে এই তিনজন নিজেদের তেএিশটা বছর উৎসর্গ করেছেন আর্ত মানবতার সেবায়। যে মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন তাঁরা করে গেলেন তাদের প্রতি রইল আমাদের প্রাণ ঢালা অভিনন্দন। তোমরা দীর্ঘজীবী হও। আবুল সরকার, সিডনি মার্চ২০১৪।

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com