শাওমির অবিশ্বাস্য উত্থান

সোমবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২০ | ১২:১৬ পূর্বাহ্ণ | 275 বার

শাওমির অবিশ্বাস্য উত্থান

দশ বছর আগে যাত্রা শুরু করা শাওমি এখন ত্রিশ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানী, মোবাইল ফোন বিক্রির অংকে তাদের ওপরে আছে শুধু স্যামসাং ও আইফোন। এই যাত্রাটাকে রূপকথার যাত্রা বললে ভুল হয় না মোটেও, তবে রূপকথার মতো মসৃণ ছিল না যাত্রাপথ।

সফটওয়্যার কোম্পানী হিসেবে নিবন্ধন করা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ব্যবহারকারীদের জন্যে সহজ এবং সময়োপযোগী কিছু কাস্টম ইউজার ইন্টারফেস বানানোটাই ছিল প্রাথমিক লক্ষ্য। লেই জুন নামের আধাপাগল আর ছন্নছাড়া স্বভাবের এক তরুণ সিক্স ডিজিটের স্যালারি আর দারুণ সম্ভাবনাময় একটা কর্পোরেট ক্যারিয়ার ছেড়ে এসেছিলেন উদ্যোক্তা হবার নেশায়, সঙ্গে পেয়েছিলেন আরও কয়েক বন্ধুকে।

তাদের কেউই নিশ্চিত ছিলেন না, তারা আসলে কি করতে চাইছেন, কতটা করতে পারবেন, মানুষ তাদের উদ্যোগকে কিভাবে নেবে- কোন ধারণাই ছিল না এসব বিষয়ে। কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর নিত্যনতুন আইডিয়া দিয়ে মার্কেটে জায়গা করে নেয়ার পাঁচ বছর পরে সেই তরুণেরা আবিস্কার করলেন, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মোবাইল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে তাদের কোম্পানীটি, শাওমি নামে যাকে আজ পুরো বিশ্বের মানুষ চেনে!

মোবাইল ফোন মার্কেটে একটা বিপ্লব করেছে শাওমি, স্বল্প দামে ভালো ফোন গ্রাহকের হাতে তুলে দেয়ার যুদ্ধটা তারা শুরু করেছিল, তাদের দেখাদেখি একটা ভারসাম্যমূলক প্রতিযোগীতায় আসতে বাধ্য হয়েছে অন্যান্য মোবাইল ব্র‍্যান্ডগুলোও। দামের ব্যাপারে একচেটিয়া মনোভাব পুষে রাখতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো, অ্যান্ড্রয়েড ফোনের দামকে মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে নিয়ে আসাটা শাওমির কারণেই সম্ভব হয়েছে। স্যামসাং আর আইফোনের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে নতুন একটা বলয় আর ভোক্তাশ্রেণী তৈরি করেছে শাওমি, তবে সেই যাত্রাটা মসৃণ ছিল না মোটেও।

যাত্রা শুরুর গল্প

শাওমির জন্ম ২০১০ সালে, সফটওয়্যার কোম্পানী হিসেবেই জন্ম হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির। কিংসফট মোবাইলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার চাকুরী ছেড়ে নিজের একটা স্টার্টআপ চালু করেছিলেন লেই জুন। তাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন আরও সাতজন। এই আটজনের সবার বয়স ছিল ত্রিশ থেকে চল্লিশের ভেতরে, এই বয়সে রক্ত গরম থাকে, ঝুঁকি নিতে ভয় পায় না লোকে। ওরাও ঝুঁকি নিলেন, সবকিছু ছেড়ে শূন্য থেকে শুরু করার একটা মিশনে নামলেন। অনেকে ভয় দেখালো, পরিবারের পিছুটান ছিল, কিন্ত সেসবের তোয়াক্কা না করে সামনের দিকে দেখতে চাইলেন তারা।

শাওমি হেডকোয়ার্টার, চীন

লক্ষ্য ছিল, অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের জন্যে একটা সহজ আর ব্যবহারযোগ্য ইউজার ইন্টারফেস সিস্টেম বানাবেন তারা। সেটার নাম দেয়া হলো মিইউআই (MIUI). এখন যারা শাওমির মোবাইল ব্যবহার করেন, তারা এই শব্দটার সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই পরিচিত। ২০১১ সালে মিইউআই- এর কাজ যখন শেষের দিকে, তখনই তারা পরিকল্পনা করলেন, নিজেদের বানানো মোবাইল ফোনেই এই সফটওয়্যার ইউজার ইন্টারফেসের ব্যবহার করবেন তারা।

বাজারে এলো শাওমির প্রথম মোবাইল

যেই ভাবা সেই কাজ, শুরু হলো শাওমি ব্র‍্যান্ডের নতুন ফোন বাজারে আনার প্রক্রিয়া। তখনও খুব বেশি বিনিয়োগকারীর কাছে যেতে পারেননি তারা। মোবাইলের প্রসেসর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোয়ালকমের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তারা, একটা পার্সেন্টেজের বিনিময়ে লেই জুন তাদের কাছ থেকে প্রসেসরের সরবরাহ চাইলেন বিনামূল্যে। কোয়ালকমও জুনের ওপর ভরসা করে চুক্তিটা করলো, ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে বাজারে এলো মি-ওয়ান নামের হ্যান্ডসেটটি। দাম রাখা হয়েছিল ১৯৯৯ ইউয়ান, বাংলাদেশী টাকায় প্রায় বিশ হাজার টাকার মতো।

ভিনি, ভিডি, ভিসি!

ইতালিয়ান একটা প্রবাদ আছে, ভিনি, ভিডি, ভিসি- যেটার বাংলা মানে দাঁড়ায় এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। মোবাইল মার্কেটে শাওমির গল্পটা অনেকটা এই টাইপেরই। প্রথম মোবাইলটাই দারুণ সাড়া ফেললো। চীনের মানুষ এত কম দামে এই কনফিগারেশনের ফোন পেয়ে অভ্যস্ত নয়, একই ক্ষমতার স্যামসাং ফোন কিনতে গেলে দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি টাকা খরচ করতে হতো।

কাজেই এই জায়গায় দারুণভাবে বাজীমাত করলো শাওমি। তাদের বিজনেস স্ট্র‍্যাটেজিটাও ঠিক হয়ে গেল এখান থেকেই- কম দামে সেরা পণ্য। আর সেকারণেই ক্রেতাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো শাওমি। একেকটা ফোন বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে যেতে থাকলো। বাড়তে থাকলো প্রি-অর্ডারের পরিমাণ। এগুলো সব ২০১৪-১৫ সালের ঘটনা।

শাওমি এখন বিশ্বের তৃতীয় সর্ববৃহৎ মোবাইল প্রস্তুতকারী কোম্পানী, স্যামসাং এবং অ্যাপলের পরেই এর অবস্থান। ২০১৫ সালে এক দিনে ২১ লক্ষেরও বেশি মোবাইল বিক্রির রেকর্ড গড়েছিল প্রতিষ্ঠানটি, যেটা গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ঠাঁই পেয়েছে। চীন জয় করার পরে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে তারা, সেখানেও সফলতার মুখ দেখেছে।

এখন তো দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপেও শাওমির বিশাল বাজার তৈরী হয়েছে। নতুন একেকটা ফোন রিলিজ হয়, আর প্রযুক্তির বাজারে বড়সড় একটা ধাক্কা লাগে। ভারতে ফ্লিপকার্ট বা অ্যামাজনে শাওমির নতুন মোবাইল বিক্রির ঘোষণা আসতে না আসতেই প্রি-অর্ডারের মিছিল শুরু হয়, সেই ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খেতে হয় বিক্রেতাদের।

শাওমির নতুন ফোন রিলিজ হলেই কেনার হিড়িক পড়ে যায়

শাওমির ব্যবসার পদ্ধতিটা খুব সহজ- যতো বেশি বিক্রি, ততো বেশি লাভ। ব্র‍্যান্ডভ্যালু বিক্রি না করে তারা দামটা ক্রেতার নাগালের মধ্যে রাখার চেষ্টা করে। যে ফোনটা বানানোর পেছনে দশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে, সেটা শাওমি কখনও বিশ হাজার টাকায় বাজারে ছাড়ে না, আইফোন বা স্যামসাং যেটা করছে। স্যামসাংয়ের পঞ্চাশ হাজার টাকার ফোনে যে কনফিগারেশন, সেই একই কনফিগারেশনের শাওমি মোবাইলের গ্রাহক পেয়ে যাচ্ছে বিশ হাজার টাকায়, তাহলে লোকজন শাওমির পেছনে ছুটবে না কেন? আরও পাঁচ বছর আগে থেকেই শাওমির গায়ে ‘প্রাচ্যের আইফোন’ তকমাটা লেগে গেছে, সেটাকে ঝেড়ে ফেলার কোন চেষ্টা শাওমি করেনি, বরং বাজেটটা ঠিক রেখে বিক্রির সংখ্যায় আইফোনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে তারা।

শাওমি কী করে এত কম দামে মোবাইল বিক্রি করে?

অনেকেরই জানার আগ্রহ, শাওমি কীভাবে মোবাইলের দাম এত কম রাখে? এটার একটা বড় কারণ হচ্ছে, শাওমির প্রমোশনাল কস্ট বলতে গেলে জিরো। বিজ্ঞাপনের পেছনে তারা খুবই কম খরচ করে। ইদানিং অবশ্য টিভি বিজ্ঞাপনে খানিকটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তাদের। এরচেয়ে বরং তারা ‘শাওমি ইউজার মিটআপ’ বা ‘ডিনার ফর দ্য ফ্যানস’ টাইপের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, সেখানে গ্রাহকের অভিযোগ, পরামর্শ সবকিছুই মনযোগ দিয়ে শোনে তারা, সেভাবে নিজেদের আপগ্রেড করার চেষ্টা করে।

শাওমির আয়ের আরেকটা উৎস হচ্ছে বিজ্ঞাপন, যারা শাওমির মোবাইল ব্যবহার করেন, তারা ফোনের নিজস্ব অ্যাপগুলোতে ঢুকলেই ৫/১০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনের সম্মুখীন হন। শুরুর দিনগুলোতে এটা ছিল না, পরে সংযুক্ত হয়েছে। শাওমির পলিসিতেই এই বিজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করা আছে। এটাও শাওমির আয়ের একটা বড় উৎস, যদিও গ্রাহকেরা এটা নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন।

শাওমি অফলাইনের চেয়ে অনলাইনেই বেশি সক্রিয়, তাদের ভিজ্যুয়াল আউটলেটের সংখ্যা খুবই কম। এটাও তাদের কম খরচে ভালো মোবাইল সরবরাহের একটা কারণ। চীন-ভারত বলুন কিংবা বাংলাদেশ, শাওমি মূলত অনলাইনেই বেশি বিক্রি হয়। তার ওপর ফ্ল্যাশ সেল বা ফ্ল্যাট ডিসকাউন্টের অফার তো আছেই, বাংলাদেশে যেমন ইভ্যালিতে শাওমির নানা মডেলের মোবাইল ফোনের ওপর ৫০% ছাড় চলছে। পত্রিকায় শাওমির বিজ্ঞাপন দেখা যায় না, বরং শাওমি ওয়ার্ড অফ মাউথের প্রচারণায় বিশ্বাস করে। এই যে আপনি এই লেখাটি পড়ছেন, এটাও কিন্ত শাওমির এক ধরণের প্রচারণা হিসেবেই কাজ করছে। এভাবেই শাওমি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।

তারুণ্যের চাহিদা পূরণ

তারুণ্যের চাহিদা ধরতে পারাটাও শাওমির আগ্রাসনের বড় কারণ। শাওমি বরাবরই গ্রাহকের পালস ধরার চেষ্টা করেছে, বুঝতে চেয়েছে ক্রেতারা কি চায়। সেভাবেই তারা মোবাইলের কনফিগারেশন সাজিয়েছে। মি লাইনআপ, রেডমি লাইনআপ, পোকোফোন সিরিজ- একের পর এক নতুন সংযোজন এসেছে শাওমির ভাণ্ডারে, গ্রাহকেরা বিরক্ত হয়ে যায়নি। বাজেটের মধ্যেই মোবাইলের প্রসেসর আর ক্যামেরা নিয়ে প্রচুর বৈচিত্র‍্য উপহার দিয়েছে শাওমি, সেকারণেই তারা টিকে আছে লম্বা সময় ধরে।

শাওমি মোবাইল ফোনের বাজারটা এত আগ্রাসীভাবে দখল করেছে যে, এই প্রতিষ্ঠানের যে আরও অনেক পণ্য আছে, এটা অনেকেই জানে না। শাওমির আরও অনেক পন্যের মধ্যে আছে ফিটনেস ব্যান্ড, ড্রোন, স্মার্ট লাইট বাল্ব, রোবট ভ্যাকুয়াম ক্লিনার এবং পাওয়ার ব্যাঙ্কের জন্যও বেশ পরিচিত। এছাড়া সিকিউরিটি ক্যামেরা, মিডিয়া স্ট্রিমিং ডিভাইস, টেলিভিশন, ল্যাপটপ, এমনকি স্মার্ট জুতাও প্রস্তুত করে থাকে এই কোম্পানিটি। কিছুদিন আগে শাওমি ইলেকট্রিক স্কুটারের জগতেও পা ফেলেছে। চীনের বাজারে আনা তাদের স্মার্ট স্কুটারটি একবার চার্জ দিলে কমপক্ষে ১৮ মাইল পাড়ি দিতে সক্ষম।

দশ বছর আগে যাত্রা শুরু করা শাওমি এখন ত্রিশ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানী, মোবাইল ফোন বিক্রির অংকে তাদের ওপরে আছে শুধু স্যামসাং ও আইফোন। এই যাত্রাটাকে রূপকথার যাত্রা বললে ভুল হয় না মোটেও, তবে রূপকথার মতো মসৃণ ছিল না যাত্রাপথ। লড়াই করে করে, গ্রাহকের মানসিকতা বুঝেই শাওমি রাজত্ব করছে এই বাজারে, নিজেদের পরিণত করেছে জায়ান্টে। কে জানে, কিংসফটের সিইও পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার দিন লেই জুন বোধহয় এতটা স্বপ্নেও ভাবেননি!

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com