রাতুলের তিন নম্বর মন খারাপ

শনিবার, ২৩ মে ২০১৫ | ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ | 1017 বার

রাতুলের তিন নম্বর মন খারাপ

ভেনে পড়ে। মোটামুটি ধরনের স্টুডেন্ট। অঙ্ক ক্লাসে সে খুব সহজ একটা সরল অঙ্ক ভুল করেছে। অঙ্কটা সে আগেও অনেকবার করেছে। প্রতিবারেই সে প্রথমবার অঙ্কটা ভুল করে। কিন্তু সঠিক উত্তরটা সে জানে। অন্য সবাই অঙ্কটা প্রথমবারই ঠিকঠাকভাবে করে ফেলে। সে কোনোভাবেই প্রথমবার অঙ্কটা সঠিকভাবে করতে পারে না। ক্লাসের অঙ্ক টিচারও জানে ব্যাপারটা। তারপরও টিচার বারবার তাকেই অঙ্কটা করতে দেয়। এটা কি এক ধরনের খেলা? তার খুব মন খারাপ হয়। আর অন্য সব বন্ধুদের কাছে নিজেকে অসম্ভব অসহায় বলে মনে হয়। বিশেষ করে কেউ কেউ যখন তার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসে।

স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানে কিংবা প্যারেন্টদের মিটিংয়ে সবার মা কিংবা বাবা আসে। তার বাসা থেকে প্রায়ই কেউ আসে না। কারণ তার বাবা দেশের বাইরে থাকে। মা কেন জানি কখনো আসতে চায় না। মাত্র একবার ছোট চাচা এসেছিল। তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু তার রাতুলের মন খারাপ। সে মন খারাপের কারণগুলো বের করার চেষ্টা করছে। দুটো কারণ সে বের করতে পেরেছে। প্রথমটা হলো সকাল থেকে বাবার পাঠানো কলমটা পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয়টা হলো আজ স্কুলে টিচারের কাছে সে বকা খেয়েছে। তৃতীয় কারণটা সে ধরতে পারছে না।

সে ক্লাস সেখুব ইচ্ছে করে মা কিংবা বাবা কেউ একজন তার স্কুলে আসুক। বিশেষ করে বাবা। মাঝে মাঝে অন্যদের মা বাবারা টিফিন পিরিয়ডে এসে ছেলেমেয়েদের পাশে বসে হাতে তুলে টিফিন খাইয়ে দেয়। রাতুল শুধু দূর থেকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যে আবীরের সাথে তার বেশ ভাব। আবীর ক্লাসের ভালো ছাত্রদের একজন। তাছাড়া বেশ স্মার্ট আর চটপটে স্বভাবের। কেন জানি আবীর তাকে বেশ পছন্দও করে। কিন্তু কেন সে তাকে এত পছন্দ করে তা সে ভেবে বের করতে পারেনি। মাঝে মাঝে মনে হয় আবীর ওর সাথে একই ক্লাসে না পড়লে সে হয়তো ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়াতো। হঠাৎ আবীরের ডাকে সে চমকে ওঠে।

কিরে এখানে একা একা বসে কি ভাবছিস? টিফিনের ঘণ্টা সেই কখন পড়েছে। চল কমনরুমে গিয়ে একসঙ্গে টিফিন খাই?
নাহ, কমনরুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। ক্লাসে অঙ্কটা পারিনি বলে সবাই মুখ টিপে হাসবে।
কিচ্ছু হবে না চল। আমি সবাইকে বলবো সাহস থাকে তো অঙ্কে আমাকে চ্যালেঞ্জ কর? শুধু শুধু রাতুলের পিছু নিবি না।
নাহ রে যেতে ইচ্ছে করছে না।
আচ্ছা আমি না হয় টিফিন বক্সটা এখানে নিয়ে আসি। দুজনে মিলে একসাথে খাওয়া যাবে। টিফিন খেতে খেতে সান্ত্বনার সুরে আবীর বললো, ‘স্যার প্রায় ইচ্ছে করে তোকে ওই একটা অঙ্কই করতে বলে। আর তুই ভুল করিস আর স্যার বকা দেয়ার একটা কারণ খুঁজে পায়। আমি আজ বাসায় গিয়ে বাবাকে ব্যাপারটা বলবো। বাবা নিশ্চয়ই কিছু একটা করবেন।’
রাতুল মাথা নিচু করে থাকে। তার বাবা বিদেশে গিয়েছে সেও অনেক বছর। অনেকের বাবাই তো বিদেশে থাকে। দু’এক বছর পর পরই তো দেশে বেড়াতে আসে। তখন কত মজা হয়। আসার সময় কত খেলনা আর জামাকাপড় নিয়ে আসে। তার বাবা ওই যে কবে গেছে সে মনেও করতে পারে না। তারপর কখনো দেশে আসেনি। মা ও ছোট চাচার কাছে শুনেছে ঠিকঠাক কাগজপত্র জোগাড় করে না আসলে নাকি আর বিদেশে যেতে পারবে না। এই বিষয়টা রাতুলের মাথায় ঢোকে না। বিদেশে না যেতে পারলে না যাবে। প্রায় সবার বাবাই তো দেশে থাকে। তাহলে শুধু তার বাবার দেশে ফিরে আসলে সমস্যা কোথায়?

এই ব্যাপারে মাকে প্রশ্ন করে কোনো লাভ হয় না বরং খারাপ লাগে। মা জবাব না দিয়ে শুধু চোখের পানি মোছে। আচ্ছা ছোট চাচাকে জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়? ছোট কাকা সান্ত্বনার সুরে বলে, ‘চিন্তা করিস না রাতুল। দেখবি তোর বাবা এইবার সব কাগজপত্র তৈরি করে কিছুদিনের মধ্যে চলে আসবে। তুই এক কাজ কর। তোর জন্য বিদেশ থেকে যা যা আনতে হবে তার একটা লিস্ট তৈরি করে আমাকে দে। আমি তোর বাবাকে ই মেইলে আগেভাগেই পাঠিয়ে দেব যেন আসার আগে হুড়াহুড়ির মধ্যে আবার ভুলে না যায়।’

বিদেশ থেকে যখনই বাবার বন্ধু-বান্ধব কেউ আসে তখনই বাবা তাদের কাছে খেলনা জামাকাপড়, খেলার ব্যাট, চকলেট আরও কতকিছু পাঠিয়ে দেয়। যখন ছোট ছিল তখন ওগুলো পেলে খুব ভালো লাগতো। কিন্তু এখন কেন জানি মনে হয়, শুধু যদি বাবা ফিরে আসতো। তার আর কোনো কিছুরই দরকার নেই।

সে বাবাকে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। স্বপ্নে দেখল তার বাবা দেশে ফিরে এসেছে। বাবা তাকে আর মাকে নিয়ে সন্ধ্যায় হাতিরঝিলে বেড়াতে এসেছে। সে আগেও অনেকবার ছোট চাচার সাথে হাতিরঝিলে গেছে। কিন্তু এত সুন্দর আগে কখনো লাগেনি। মা একটা লাল শাড়ির আঁচলে মাথা ঢেকে কারণে অকারণে বাচ্চাদের মতো খিল খিল করে হাসছে আর যা দেখছে তাতেই অবাক হচ্ছে। তার নিজেরও সবকিছু যেন অন্যরকম লাগছে। রাতের ফোয়ারা আর রংবেরঙের আলো যেন চারিদিকে বিস্ময় ছড়িয়ে দিয়েছে। আশে পাশের সব ছেলেমেয়েগুলো যেন ঠিক তারই সমবয়সী আর বাবা মাকে ছাড়া মনে হয় অন্য কারো আজকের সন্ধ্যায় হাতিরঝিলে ঢোকা নিষেধ।
বাবা পাশের এক আইসক্রিমওয়ালাকে দেখিয়ে তাকে বললো, ‘রাতুল আইসক্রিম খাবে?’
রাতুল বললো, ‘বাবা তুমি আসবে ভেবে আমি টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে জমিয়েছি।’ বলেই সে তার প্যান্টের পকেট থেকে মোচড়ানো কয়েকটি টাকা বের করে বাবার হাতে ধরিয়ে দিল।
বাবা মিষ্টি হেসে তার মার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ওগো শুনছো, আমাদের রাতুল অনেক বড় হয়ে গেছে।’ মা মুখে তার জবাব না দিয়ে হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঘুম ভেঙে গেলে সে টের পেলো তার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। ওপাশে মোবাইল ফোন বেজেই চলেছে। মা হয়তো বাসায় নেই। অনেক কষ্টে উঠে গিয়ে সে ফোনটা ধরলো। ওপাশে বাবার গলার আওয়াজ শুনতে পেলো। ‘রাতু বাবা কেমন আছো? আজ স্কুলে যাওনি?’
‘না বাবা স্কুলে যেতে পারিনি।’
‘তোমার গলার স্বর এরকম লাগছে কেন? জ্বর-টর হয়নি তো?’
‘বাবা তুমি চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা বাবা, তুমি কি আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে?’
‘হ্যাঁ বাবা, এইযে আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। তোমার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?’
‘না বাবা। তুমি মাথায় হাত রাখার পরে এখন বেশ ভালো লাগছে। জান বাবা, গত রাতে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। তোমার অপেক্ষায় দিন গুণতে আর ভালো লাগে না। তুমি চলে এসো বাবা। আমার আর কিচ্ছু লাগবে না। আমি তিন নম্বর মন খারাপের কারণটা ধরতে পেরেছি, বাবা।’
ওপাশ থেকে রাতুলের বাবা কিছু বলছে। কিন্তু রাতুল তার কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। সে ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে। মোবাইলটা কাত হয়ে বালিশের ওপর পড়ে আছে। ওপাশ থেকে রাতুলের বাবার হ্যালো, হ্যালো, আর কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

» সাহিত্য ডেস্ক

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০ 

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com