সার্থক জীবন আমারঃ ৮৭তম জন্মদিনের কথা

শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০১৯ | ৬:৪৯ অপরাহ্ণ | 340 বার

সার্থক জীবন আমারঃ ৮৭তম জন্মদিনের কথা

পৈত্রিক বাসস্থান পাবনা জেলার সাবেক সাঁথিয়া থানার ভুলবাড়ীয়া নামক অজ পাড়াগাঁয়ে হলেও আমার জন্ম হয়েছিল রাজশাহী জেলার ন’হাটাতে আমার দিদিমনির গৃহে, ১৯৩৩ সালের ৪ অক্টোবর তারিখে আশ্বিনের হালকা শীতল আবহাওয়ায়। কিন্তু জন্মের দু’এক মাসের মধ্যেই মায়ের কোলে চড়ে চলে আসি ইছামতী নদী তীরবর্তী ভুলবাড়িয়াতে। হামাগুড়ি দিয়ে চলা হাঁটা শেখা-দৌড়ানো সব ঐ গ্রাম থেকেই শিখেছিলাম। আজ দৌড়ানো নিষেধ, খোলামেলা জায়গাও নেই, নেই কোন মাঠও দৌড়ানোর মত। তবে বৃষ্টি না থাকলে আর অত্যধিক এবং অসহনীয় গরম না পড়লে সকাল বেলায় ঘন্টাখানেক হাঁটি। ওতেই যথেষ্ট আরাম বোধ করি, শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধে তৃপ্তি পাই।

বাবা প্রয়াত রমেশ চন্দ্র মৈত্র ছিলেন ভুলবাড়িয়া গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিধ্যালয়ের শিক্ষক, অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ভাল শিক্ষক এবং সৎ মানুষ হিসেবে। সে কালে গ্রামে রাজনীতির প্রচলন ছিল না-তাই তিনি ছিলেন রাজনীতির সংশ্রবহীন। তবে ছিলেন মাহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের ভক্ত।

সে কালে গ্রামে সংবাদপত্রের প্রচলন ছিল না। কিন্তু বাবা সংবাদপত্র ভক্ত। তখন অবিভক্ত ভারত। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আনন্দবাজার রাখতেন। ডাকে আসত।

সে কারণেই কি সংবাদপত্র ভক্ত আমিও হয়েছি সেই বাল্যকাল থেকে? বাবাকে হারাই ১৯৫৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলাম তখন। এডওয়ার্ড কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি।

অসাধারণ জনপ্রিয় এবং কৃষক দরদী ছিলেন আমার বাবা। তাই আদৌ কোন রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও কৃষকদের অনুরোধে তিনি শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক কর্তৃক প্রচলিত ঋণ সালিশী বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ভুলবাড়িয়া ইউনিয়নের। এই বোর্ডের উদ্দেশ্য ছিল ১৩৫০ এর ভয়াবহ মন্বন্তরে (পঞ্চাশের মন্বন্তর) যে কৃষকেরা পেটের দায়ে জমি জলের দামে বিক্রী করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন যৌক্তিকতা বিবেচনা করে সেই জমিগুলি উদ্ধার করে তার মালিক কৃষকদের কাছে প্রত্যর্পণ করা। যতগুলি আবেদন বাবা পেয়েছিলেন তার সবগুলি জমি উদ্ধার করে তিনি কৃষকদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

মা ননীবালা মৈত্র ছিলেন গৃহিনী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ তাঁর ঘটেনি পারতেন শুধুমাত্র নাম স্বাক্ষর করতে। কিন্তু কি অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিলো মায়ের।রামায়ন মহাভারত, এই দুটি বিশাল গ্রন্থ ছিল তাঁর মুখস্ত। হাতের রান্না ছিলো অপূর্ব। গ্রামের অনেকে চেয়ে নেমন্তন্ন নিতেন। মায়ের রান্না খাওয়ার লোভে। কিন্তু নিজের কোন অহংকার ছিল না বা কোন লোভ ছিল না।গরীবকে ভালবাসতেন। লোভ লালসাহীন ও গরীব প্রীতি বাবা-মা উভয়েরই ছিল। চেষ্টা করেছি ঐ ধারাকে আজীবন ধারণ করার জন্যে। পেরেছিও এ যাবত কাল পর্য্যন্ত। জীবনের বাকী ক’টা দিনও পারব বাবা-মায়ের ঐ দুটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে। আমি এবং আমার সহধর্মিনী পূরবীও। সংসার জীবনে নানা ঝড়-ঝঞ্ঝা অতিক্রম করেছেন তিনি। দারিদ্র্য কদাপি তাঁর পিছু ছাড়ে নি। আমার দীর্ঘ কারাজীবনে একদিকে নিজের উদ্যোগে ইন্টারমিডিয়েট ও স্নাতক ডিগ্রী অর্জন ও স্নাতকাত্তর এক বছর পড়েও শারীরিক কারণে মাষ্টার্স দিতে পারেননি। আমার দীর্ঘদিন জেল জীবনে তাঁকে একাই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে এবং সন্তানদের লালন পালন শিক্ষা দীক্ষার ব্যবস্থাও করতে হয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এক্ষেত্রেও পূরবী সফল।

বাবার প্রাইমারী স্কুল থেকেই চর্তুথ শ্রেণী পর্য্যন্ত ভুলবাড়িয়াতে পড়াশুনা শেষ করে ভুলবাড়িয়া গ্রাম থেকে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে তিন মাইল দূরে আতাইকুলা হাই স্কুলে পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্য্যন্ত পড়ি। আতাইকুলা হাই স্কুলের স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষক সুধীর ঘোষ, ইংরেজী ও ইতিহাসের শিক্ষক সুরেন্দ্র নাথ সিংহ ও এম. এ. ইসহাকের স্নেহের ছাত্র ছিলাম বলে আজও গর্ববোধ করি।

অষ্টম শ্রেণীতে উঠলাম ১৯৪৮ সালে। পাবনা শহরে চলে এলাম বাবা-মা-ভাই-বোন সহ স্থায়ীভাবে। ঐ বছরেই শুরু হলো ভাষা আন্দোলন তাতে অংশ নিলাম। ভর্তি হয়েছিলাম পাবনা গোপাল চন্দ্র ইনষ্টিটিউশনে। তখন অত্যন্ত নাম করা স্কুল ছিল সেটি। ওখানে একগুচ্ছ ভাল শিক্ষকের সান্নিধ্য পেলাম। প্রধান শিক্ষক রাধাবিনোদ বসাক, সহ প্রধান শিক্ষক মথুরা নাথ মুখার্জী, হরিপ্রসাদ ঘোষ, জ্যোতিভূষণ চাকী-যাঁদের সান্নিধ্য গ্রাম থেকে আসা আমাকে বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছে, পৃথিবীটাকে দেখতে ও বুঝতে শিখিয়েছে। ঐ স্কুল থেকেই ১৯৫০ সালে ঢাকায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত সেকেন্ডারী এডুকেশন বোর্ডের নিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে উর্ত্তীণ হই বোর্ডের প্রথম ব্যাচে।

এবারে জীবনের প্রথম চাকুরী নিতে হলো পাবনার প্রথম ওষুধ প্রস্তুত কারখানাএডরুক লেবরেটরীজ (ইষ্ট পাকিস্তান ড্রাগস এন্ড কেমিক্যালস্) লিমিটেডে তাদের অফিস সুপারিন্টেন্ট হিসেবে। নেহায়েতই সাংসারিক আর্থিক দৈন্য কিছুটা হলেও ঘুচানোর লক্ষ্যে। দু’বছর চাকুরী করে সংসারের দৃশ্যমান কোন উন্নতি না হওয়ায় বাবার অনুমতি নিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই ১৯৫২ সালে। তার আগেই সংগঠিত করি ভাষা আন্দোলন অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সাথে।

১৯৪৭ সালে উগ্র সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে। শুরু হয় রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক, সামাজিক বিভাজন ও সকল ক্ষেত্রেই মারাত্মক শূণ্যতা ও সংকট। ভাষা আন্দোলন বাঙালি মুসলমানদের সজাগ, সচেতন করতে সহায়ক হলো। তরুণেরা উদ্বুদ্ধ হতে থাকলো অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চিরায়তবাঙালি সংস্কৃতিতে। মেঘাচ্ছন্ন রাজনৈতিক সাংষ্কৃতিক আকাল পরিচ্ছন্ন করার প্রয়োজনীয়তা অনূভূত হলো। সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা এক ঝাঁক তরুণ পাবনাতে গড়ে দুলি “শিখাসংঘ” নামে এক প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথকে আড়াল করার অপচেষ্টা এবং নজরুলকে বিকৃতভাবে উপস্থানের উদ্যোগ প্রতিরোধই ছিল শিখা সংঘ গড়ে তোলার মূল প্রেরণা।

টগবগে রাজনৈতিক রণেশ মৈত্র মার্কসবাদী রাজনীতি ও সাহিত্য অধ্যায়নের শুরু শিখাসংঘ থেকেই। একই প্রেরণায় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করা এবং এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তির পর।

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০ 

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com