ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি ও নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি –

বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ | ১২:০৩ অপরাহ্ণ | 570 বার

ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি ও নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি –
ফোরকান বেগম
সারাবছরই কোনো না কোনো ধরনের পিঠাপুলি খাওয়ার রেওয়াজ সেই আদিকাল থেকেই বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে। তবে শীতকালই হলো হরেক রকম পিঠাপুলি খাওয়ার মৌসুম। আমার পিঠাশিল্পী নানী উম্মে সাইদ ফাতেমা কেবল নামেই আধুনিক ছিলেন না, শতরকম পিঠাও তিনি তৈরি করতে পারতেন- ভাপাপিঠা চার-পাঁচ রকম (ঝাল, মিষ্টি, নারকেল ভাপা, পাতিল ভাপা, বাঁশভাপা), চিতই পিঠা, দুধচিতই, কুলি পিঠা, সমুচাপিঠা (ঝাল ও মিষ্টি),ঐতিহ্যবাহী ফুলপিঠা বা নক্সাপিঠা, তৈলপিঠা, ঝুরি পিঠা (একাধিক রকম), ঝুরির মোয়া, মুড়ির মোয়া, চুইপিঠা, কলাচুইপিঠা, তালের বুলবুলা, তালের রুটিপিঠা, কাঁঠালের বুলবুলা, কাঁঠালের রুটিপিঠা, পাটিশাপটা (ঝাল ও মিষ্টি), আন্দেশাপিঠা, গোটাপিঠা (ঝাল ও মিষ্টি), ডিমচিতই, চিটারুটিপিঠা, পাকানপিঠা, গোকুলপিঠা, চুটকিপিঠা, জামদানীপিঠা, হাঁড়িপিঠা, চাপড়িপিঠা, পাতাপিঠা, জিলাপিপিঠা, কড়িপিঠা, রসপিঠা ইত্যাদি বহুরকম পিঠার নাম করেছেন নানী। সব পিঠার নাম আমার মনেও নেই। ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি আমাদের দেশের সংস্কৃতির এক বিরাট অংশ। আবহমানকাল থেকে চলে আসা পিঠাপুলির উৎসব এবং শতাধিক রকমের পিঠা তৈরির মধ্যদিয়ে এদেশের নারীদের শিল্পী সত্ত্বার পরিচয়) মেলে। এদেশের নারীরা কত যে গুণের অধিকারী, ধৈর্য্যশীলা ও কঠোর পরিশ্রমী তার পরিচয় পাওয়া যায় তাদের তৈরি পিঠার নক্সা, রকমারি ডিজাইন ও বানানোর পদ্ধতি দেখলে।শীতকালই পিঠা খাওয়ার উত্তম সময়। শীতে পিঠা খেতেও খুব স্বাদ। হেমন্তে নতুন ধান ঘরে ওঠে। ধান মাড়াই, সিদ্ধসহ প্রক্রিয়াজাত করা শেষ হতে না হতেই শীত এসে হাজির হয়। তখন নতুন ধানের নতুন চালে হরেক রকম পিঠা বানাতে থাকে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে। মেহমানেরও কমতি নেই। পিঠপুলির মজা পেতে শহর থেকেও আত্মীয়স্বজনরা গ্রামে বেড়াতে যায়। পিঠা খাওয়া উপলক্ষে গ্রামের বাড়িতে গেলে আরেকটি বাড়তি আনন্দ পাওয়া যায়। গ্রামের পাড়া-পড়শীদের দেখা সাক্ষাৎ পাওয়ার সাথে সাথে বহু আত্মীয়-স্বজনদেরও দেখা পাওয়া যায়। আজকাল মোবাইলের যুগে গ্রামে একটি মিলনমেলা হয়ে যায়, সাথে হয় পিঠা উৎসব।

আজকাল বড় বড় শহর, গঞ্জ, হাট-বাজারগুলোতেও কয়েক ধরনের পিঠার বেশ প্রচলন দেখা যায়, বিশেষ করে চিতই পিঠা, ভাপাপিঠা, তেলের ডুবাপিঠা। রাস্তার ধারে গরিব নারী-পুরুষ এ পিঠা তৈরি করে বিক্রি করে। বেশ ভালোই চলে পিঠার ব্যবসা। গরিব, ধনী, ছাত্র-ছাত্রী, রিক্সাওয়ালা অনেকেই এসব পিঠা সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার বা বিকালের নাস্তা হিসেবে খেতে পছন্দ করে। ভাপা পিঠাতে গুড়, নারকেল আর চিতই পিঠাতে সহযোগ হিসেবে ধনেপাতার চাট্নি বা শুঁটকির ভর্তা বা গুঁড়ের টুকরা দেওয়া হয়। পিঠা ফেরি করে এতে বহু গরিব লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পরিবার পরিজন নিয়ে পিঠা বিক্রয়ের আয় দিয়েই চলেছে তাদের ঘর-সংসার। এতে আরেকটি লাভও হচ্ছে। বিদেশি ফাস্ট ফুডের দিকে যতটা ঝোঁক ছিল সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে, সে ঝোঁকটি এখন পিঠার দিকে গেছে।

পিঠার কদর অভিজাত শহরবাসীদের মধ্যেও আছে। পিঠাঘরসহ বেশকিছু হোটেল, দোকানে পিঠা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। অনেক ধনীব্যক্তি, ছাত্র-ছাত্রীরাও এসব দোকানে পিঠা খেয়ে রসনা তৃপ্ত করে। প্রতি বছরই ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে পিঠা মেলা বসে। বিভিন্ন ক্লাব, এনজিও এসব পিঠামেলার আয়োজন করে।

এসব মেলায় লোকের ভিড় থাকে প্রচুর। নক্সিপিঠা, ঝুরিপিঠা, নারকেলের লাড্ডু, বরফীপিঠা বিদেশেও যায়। তা অবশ্য বাণিজ্যিকভিত্তিতে নয়। আমাদের দেশের নানারকম পিঠা যা কয়েক মাস সংরক্ষণ করা যায় সেসব পিঠা বাজারজাত করাসহ যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা যায়, তবে তা থেকে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করতে পারি।

আমাদের দেশের মেলাগুলোতে পিঠার উৎসবে অনেক সময় বিদেশিদের দেখা যায় মজা করে পিঠা খেতে। নক্সা করা পিঠার বাহারি ডিজাইন দেখে তারা অবাক হয়। কি করে বাংলাদেশের গ্রামের গরিব নারীরা এত সুন্দর নক্সা করতে পারে। সুস্বাদু পিঠাপুলি তৈরি করতে পারে? বহু প্রশ্ন করে তারা এ নিয়ে। মর্ডানাইজেশন ও ম্যাকানাইজেশন তাদেরকে এমনই এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে যে, হোটেল বা রেস্টুরেন্ট আর বার ক্লাবের খাবার খেয়ে এদের অধিকাংশের জীবন কাটে। সেদিক থেকে আমরা এখনো অনেক সৌভাগ্যশালী। এখনো বাংলাদেশের সন্তানেরা তাদের মায়ের হাতের হরেক রকম রান্না, পিঠাপুলি খেতে পারে। পিঠাপুলি আমাদের বিরাট ঐতিহ্য ও নারীর শিল্পী সত্ত্বার পরিচয় বহন করে। দেশ বিদেশে পিঠা শিল্পের বাণিজ্যিকিকরণ দরকার। তা হলে দেশের সুনাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক দরিদ্র বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের মধ্যদিয়ে তাদের জীবন মানেরও উন্নতি ঘটবে নিঃসন্দেহে।
ফোরকান বেগম
লেখক, গবেষক ও মুক্তিযোদ্ধা
৬১/জি আজিমপুর এস্টেট
ঢাকা-১২০৫

সুত্র: http://www.dailyinqilab.com/2014/02/04/158152.php#sthash.w4nqDTgT.dpuf

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০ 

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com