অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর পরিণাম

সোমবার, ১৯ আগস্ট ২০১৯ | ১০:০০ অপরাহ্ণ | 246 বার

অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর পরিণাম

আব্বু যেদিন হলে আমার কাপড় আনতে গিয়েছিল, সেদিন হল থেকে বলা হয়েছিল যে ঈদের পরে ভার্সিটি খুললে হলে উঠতে পারব। ভার্সিটি খোলার দিন ঘনিয়ে এলো। ছুটি শেষ হবার দুইদিন আগে আব্বু ম্যামকে ফোন দিল। টিকিট কাটার একটা ব্যাপার আছে, ফেরারও তো একটা প্রিপারেশন আছে। তো ম্যাম বললেন আমার হলে ফেরা হবেনা। ভার্সিটি খুলবে, আমার ব্যাপারে মিটিং হবে, ভিসি-প্রোক্টর সিদ্ধান্ত জানাবে, তারপর যদি তাদের দয়া হয়, তো আমি হলে আসতে পারব।

এর আগে না। আব্বু ফোনে যখন কথা বলছিল, এক্সপ্রেশন দেখে বুঝতেছিলাম খারাপ খবর। আমার কাছে ততোদিনে অবশ্য চোখের পানি নতুন কিছু না। ১৫ আগস্ট, দিবাগত রাতের পর থেকে অবাক হতেও ভুলে গেছিলাম অবশ্য। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার আর হলে যাওয়া হবেনা। আব্বুকে বলছিলামও হলে আর থাকব না, সাবলেটে উঠব।

আব্বু উত্তর দিছিল, সাবলেটে ওঠা তো ব্যাপার না। এইখানে তোর সম্মানের প্রশ্ন। হলে না উঠলে তুই হেরে যাবি। যে দোষ করিসনি, সেই দোষের শাস্তি তোকে পাইতে দেব না। হলে না উঠলে তো প্রমাণ হবে তোর ফল্ট ছিল। কথাগুলো শুনে অনেকদিন পরে অবাক হইছিলাম আমি। একটা মানুষ এতকিছুর পরেও এতোটা দৃঢ় থাকে কিভাবে!

আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। ক্লাস শুরু হলো। আমার একসপ্তাহ ক্লাস করা হলো না। মিডটার্মের ডেট দিয়ে দিল। সেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখ। একেতো বইখাতা কিছু সাথে নেই, তার উপর হলেও উঠতে দিচ্ছেনা। নরকযন্ত্রণাটা কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। এরমধ্যে আব্বু একাধিকবার প্রোক্টর আর প্রভোস্ট ম্যামের সাথে ফোনে যোগাযোগ করেছে।

স্যার তো আব্বুকে একবার শুনায়েও দিল, “আপনি বেশি কথা বলেন” আমি নিজে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যেতে লাগলাম দিনদিন। আমার কারণে আব্বুর এই স্ট্রেস, এই মানুষের কাছে ছোট হওয়া – এইগুলা আমি নিতে পারতেছিলাম না কোনোভাবেই। আমি নিজে ঝামেলা করলেও পরে এমন একটা সিচুয়েশন ক্রিয়েট হয়ে যায়, উল্টো আমাকে সান্ত্বনা দেয়া লাগে।

এক্ষেত্রেও তাই হলো। আমার কান্না থামানো আমার বাপের কাছে নিজের অপমানের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। আর আমার সন্তান হিসেবে নিজেকে অভিশপ্ত মনে হতে লাগলো। আব্বু অনেকবার যোগাযোগ করার পর লাস্ট পর্যন্ত প্রভোস্ট ম্যাম বললেন আমাকে হলে ঢুকতে দেয়া হবে বইখাতা নিতে। তবে শর্ত হলো সাথে আমার আব্বুকে যেতে হবে।

এই কথাই রইলো। মানুষটা জার্নি করলে অসুস্থ হয়ে যায়। এই জার্নির হ্যাপার কারণে আমি বহুবার তাকে ঢাকায় ভালো ডাক্তার দেখাইতে চাইলেও সে রাজি হয়নি। সেই মানুষটাকে এখন তার কুসন্তানের জন্য দুইদিন পরপর ঢাকায় দৌড়াদৌড়ি করা লাগতেছে! আমরা তিন তারিখ ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হলাম। ভাগ্যের কি পরিহাস, সেইদিন ছিল পরিবহন ধর্মঘট।

জানতামও না আগে থেকে কিছু। বাস পাওয়া তো যাচ্ছিলই না, একটা যদিও পেয়েছিলাম, কিছুদূর যেতে না যেতেই সেটা নষ্ট হয় গিয়েছিল। মাঝরাস্তায় এরকম বিপদ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতন। আর কোনো গাড়িও পাচ্ছিলাম না। রাস্তায় চল্লিশ মিনিটের উপর আমরা বাবা, মেয়ে দাঁড়ানো। খুব অসহায় লাগতেছিল। আমার জন্য আব্বুকেও কি বাজেভাবে ভুগতে হচ্ছিল!

এক ড্রাইভার ট্রাক থামিয়ে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলো মুরুব্বি, কই যাবেন? আব্বু আমাদের বিপদের কথা বললো। সে বললো যে সাভার যাবে, আমরা তার সাথে সাভার পর্যন্ত যেতে পারব। আব্বু জিজ্ঞেস করলো কি করবি? এভাবে যাওয়া ঠিক না হলেও রাজি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমাদের জায়গা দিতে হেল্পার উপরে উঠে গেল।

বৃষ্টির কারণে ভিজতেও হয়েছিল বেচারাকে। জীবনে প্রথম ট্রাক জার্নির অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। ভাগ্য বড় বিচিত্র জিনিস। রাস্তায় ড্রাইভার আব্বুর সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেললো। আমি ভয়তে ড্রাইভারের দিকে তাকানোরও সাহস পাইনি। নানান রকম দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরতেছিল তখন। কিন্ত লোকটা আসলেই ভালো ছিল। ভাড়া নিয়েও ঝামেলা করেনাই।

সারারাস্তা বৃষ্টি ছিল আর জ্যামও তেমন বলতে গেলে ছিলনা গাড়ি কম থাকার কারণে। আমার স্ট্রেস কিছুটা কমে গেল আবহাওয়া দেখে। খুব করে চাইতে লাগলাম আজকে যেন খারাপ কিছু না হয়। সাভার চলে আসলাম। ড্রাইভার তার যাবার জায়গা থেকেও কিছুদূর এগিয়ে আমাদেরকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়েছিল। তখনও বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা ঠিকানা বাসে চরলাম। পৌঁছলাম তিনটা বিশের দিকে। রিক্সা নিয়ে হলে আসলাম।

আমাকে হলগেটে দেখেই দাদু বললো, আপা আপনি ভিতরে ঢুকতে পারবেন না। নিষেধ আছে। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। অনুমতি পাবার পরেও এরকম আচরণ, যে দাদুকে রক্ত ম্যানেজ করে দিয়েছিলাম তার এমন প্রতিদানে আমার শরীরের সব শক্তি দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করলো। খুব কষ্ট করে চোখের পানি আটকে রাখলাম।

আমি কান্নাকাটি করলে আব্বু ভেঙে পড়বে এখন। এমনিতেই সারাদিন জঘন্য রকমের ধকল গেছে মানুষটার উপর। আমি উত্তর দিলাম, ভেতরে যাব না। গেস্টরুমে বসতেছি। আব্বু হাউস টিউটর ম্যামকে ফোন দিল। ম্যাম বললেন ছয়টার সময় দেখা করবেন প্রভোস্ট ম্যাম। আমাদেরকে এখন দুইঘন্টা ধরে গেস্টরুমে জাবর কাটতে হবে। অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ঝিনুক, পরমা আসলো। এতক্ষণে হলটাকে একটুখানি নিজের মনে হতে লাগলো। ঝিনুক দীপিকার কাছ থেকে ক্লাসনোট ফটোকপি করে এনে দিল। তাসনিমের সাথেও দেখা হয়ে গেল। তানজিম স্যার, ফাহমিদ স্যার, রুশাদ স্যারের সাথে ওরা যেদিন অসভ্যতা করেছিল, সেদিন মেয়েটা শেষ পর্যন্ত ছিল আমার সাথে। আন্দোলন থেকে তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলো বড্ড বেশি মূল্যবান আমার জীবনে। এই মানুষগুলোর সাথে পরিচয় না হলে আমার চার বছরের ক্যাম্পাস লাইফের কাছের সবাইকে এক এক করে হারিয়ে ফেলার ক্ষতটা হয়তো কখনোই শুকাতোনা আমার।

যাই হোক, ছয়টায় আব্বু প্রভোস্ট ম্যামের রুমে গেল। সাথে আমার হাউজ টিউটর ম্যাম। প্রায় দুইঘন্টা তাদের মিটিং চললো। পরে জানতে পেরেছিলাম, ম্যাম বলেছিলেন আমার এখন হলে থাকা ঠিক হবেনা, আমার লেখাপড়া করার দরকার, হলে থাকলে মেয়েরা আমাকে ডিস্টার্ব করবে- আরও নানান কথা।

বাসায় থাকতে পেপার মারফৎ জেনেছিলাম আমাকে হলের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এটা নাকি উনি জানতেনও না! প্রোক্টরকেও জানানো হয়েছিল নিয়ে যাবার পরে! উনি আমাকে নিয়ে এত ভাববেন, এতে আমার খুশি হওয়া উচিত নাকি আরও ভেঙে পড়া উচিত, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না তখন।

প্রায় দুইঘন্টা পরে আমার ডাক এলো। ম্যামের রুমে গেলাম। ম্যাম বললো, তোমার বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। যা যা বই দরকার নিয়ে এসো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ম্যাম শুধু পরশু দিনের পরীক্ষার বই নিয়ে আসব নাকি সব বই? ম্যাম একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, “সব বই আনবে। রোজ রোজ হলে আসবে নাকি?” আমাকে বলা হলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, লাগেজ গুছিয়ে হল থেকে বেরিয়ে যেতে। আমি আবারও প্রচন্ডভাবে ধাক্কা খেলাম। আমার সাথে হল সুপারকে আমার রুমে পাঠানো হলো।

আমার নিজেকে দাগী আসামি মনে হতে লাগলো, যে সুযোগ পেলেই কোনো বড় ধরণের অপরাধ করে ফেলবে। বিষয়টা যে কতটা অপমানজনক ছিল, তা লিখে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। কষ্টটা নাহয় আমার মাঝেই থাকুক। রুমে সবাই আচমকা আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। তাড়াহুড়োর মধ্যে কারো সাথে সেভাবে কথা বলতেও পারিনি। তাছাড়া আমার কাছে হল একটা অভিশপ্ত জায়গা মনে হচ্ছিল।

মনে হচ্ছিল দৌড়ে চিরতরের জন্য এখান থেকে এতদূরে চলে যাই, যেখানে আর কষ্ট পেতে হবেনা। অপমানিত হতে হবেনা। আমার পরিবারটা মুক্তি পাবে, আমার জন্য তাদেরকে আর কারও কাছে ছোট হতে হবেনা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাগেজ গোছালাম। তারপর ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

হালিম ভাইয়া নিতে এসেছিল। ভাইয়ার সাথে শ্যামলী চলে গেলাম। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে ডিবি অফিসের নাম্বার যোগাড় করলাম। ওরা বলেছিল ঢাকায় এসে যোগাযোগ করলে ফোন ফিরিয়ে দেবে। সেই ডিসি স্যারের নাম্বার নিলাম। তিনি পরেরদিন যেতে বললেন ডিবি অফিসে। আমাকে নিয়ে আব্বু ডিবি অফিসে গেলো।

যেই এডিসি আমাকে আধঘন্টার ওপরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, সে বাদে বাকি সবার সাথে দেখা হলো। আবারও আমার দম আটকে আসতে শুরু করলো। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। কারও দিকে তাকালেই মাথা যেন ঘুরে যাচ্ছিল। সেই অফিস, সেই রাস্তা, সেই মানুষগুলো- আমি ট্রমাটাইজড হয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদেরকে চা দিল। আজকে চা নিলাম। স্যার গ্রামের বাড়ি থেকে চানাচুর নিয়ে এসেছিলেন, দিলেন আমাদেরকে। খেলাম। এই মানুষগুলোর সেইদিনের ব্যবহার আর তুলে নিয়ে আসার দিনের ব্যবহার আমি মেলাতে পারছিলাম না।

ঠিক যেমন সেই মায়ের খুবলে টেনে নিয়ে যাওয়া থেকে মাথায় হাত রেখে দোয়া করে যাওয়া পর্যন্ত। ওই তিনজন নারী ছিলেন না সেদিন। তবে উনাদের সাথে জীবনে কখনো দেখা হলে খুব ভালো লাগবে আমার। শেষ মুহূর্তে যখন আমি একটু একটু করে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিলাম, এই মানুষগুলো আমার পাশে ছিল। নিজেদের পরিবার থেকে দূরে থেকে আমার পাশে ছিল। তো অনেক কথা বার্তাই হলো সেদিন।

আমাকে নাকি আমার হলের মেয়েরা চিনিয়ে দিয়েছিল। এর আগের দিন এত বড় বড় ধাক্কা খেয়েছি যে এই কথায় খুব একটা কষ্ট পেলাম না। পাঁচ বছর হলে থেকে আজ পর্যন্ত কারোর কোনো ক্ষতি করেছি বলে মনে পড়েনা। খুব ভালো প্রতিদান জুটেছে কপালে তার বদলে। অবশ্য কারা চিনিয়ে দিতে পারে আন্দাজ করতে পারছিলাম।

যারা লিস্টি করে দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিলেন, এই মেহেরবানিটুকুও তারাই করেছিলেন বলে আমার ধারণা। স্যার নাকি হলের প্রভোস্টের সাথেও আমার হলে ওঠার ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। তখন নাকি উনাকে বলা হয়েছিল আমি সুইসাইড করব কিনা, সেই ভয়তে আমাকে হলে তুলতে সাহস করতেছে না৷ এর আগেও এটেম্পট নিছিলাম আরও কি কি হইসে সব তাকে বলা হইসে। তখন এ এস পি বললো আমি সেইদিন রাতেও সুইসাইড করার কথা বলছিলাম। উনি কৌতুকের সুরেই বললেন, পরীক্ষায় দরকার হইলে সাদা খাতা জমা দিবা, কিন্তু খাতা ছেঁড়া যাবেনা।

হাসব কি কাঁদব কনফিউজড হয়ে গেসিলাম। একটা মানুষকে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া অপরাধ না, সে যদি কষ্টে, যন্ত্রণায়, অপমানে নিজেকে শেষ করে দিতে চায়, সেটা বিশাল অপরাধ! দারুণ বিচার! ডিসি স্যার বললেন আমরা যেন ভিসি স্যারের সাথে কথা বলি। উনি যদি উঠতে বলে তাহলেই একমাত্র আমার হলে ওঠা সম্ভব।

আব্বু সেই ডিসির উপর মুগ্ধ হয়ে গেল। পরেও কয়েকবার কথা বলেছে উনার সাথে। আমি লজ্জাতে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। সেই রাতে যারা খারাপ ব্যবহার করেছিল তাদের সামনে কিছু না বলে উনি ভালো ব্যবহার করেছিলেন দেখে সব ক্ষোভ উনার উপর উগরে দেয়াটা এখনো অপরাধবোধে ভোগায়। তবে ওই সময় ওই ঘটনাটা খুব বেশি দরকার ছিল।

এর আগেও একবার ওভারস্ট্রেসড হয়ে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল একবার আমার। সেদিনও এমন কিছু একটা হতে পারত। আমার ফোন ফেরত দিয়ে দিল। আমি সবার কাছ থেকে দোয়া চেয়ে এলাম।

বেরিয়ে আমরা ভিসি স্যারের অফিসে গেলাম। আমাদের মিনিট বিশেক বসিয়ে রাখার পর স্যারের পিএস ঘটনা শুনলো। তারপর বললো আগে প্রক্টর স্যারের সাথে কথা বলে আসেন। আমরা গেলাম প্রোক্টর অফিসে। সেখানে প্রায় ঘন্টাখানেক আমাদের বাইরে বসিয়ে রেখে ভেতরে ডাকা হলো। ভেতরে গিয়ে দেখলাম স্যার তিনজন ছাত্রনেতার সাথে আড্ডা দিচ্ছেন। একজন অভিভাবককে এভাবে বাইরে বসিয়ে রেখে তাদের সাথে স্যারের সখ্যতা দেখে পুরোপুরি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমাদের বসতে বলা হলো।

আমাকে দেখেই স্যার খিঁচিয়ে বলে উঠলেন, “ও! তাহলে এই সেই মেয়ে! চেহারাটা পরিচিত মনে হচ্ছিল। ও এসেছে আগে জানলে তো আমি ওকে ঢুকতেই দিতাম না আমার অফিসে!”

সেই তিনজন তখনও বসা। আমি হাত মুঠ করে থাকলাম শক্ত করে। আব্বু বললো যে ভিসি স্যারের অফিস থেকে এখানে আসতে বলা হয়েছে। এর মধ্যেই তিনজনের একজন, হাসিব আব্বুকে বললো “আঙ্কেল, আপনার মেয়ে তো আপনার মতন হয়নাই। সরকারবিরোধী কথাবার্তা বলে।” একেতো প্রথমেই স্যার অপমান করলো, তার উপর দুইজন সিনিয়রের কথার মাঝখানে কথা বলার মত অস্বাভাবিক কমনসেন্স দেখে আমি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি। জিজ্ঞেস করলাম কি বলেছি সরকার বিরোধী।

স্যার আবার ধমক দিল আমাকে। বললো, “চুপ করো! তোমাকে কেউ এখানে কথা বলতে বলেনি। এখানে সংবাদ সম্মেলন করে তোমার বক্তব্য নেয়া হচ্ছেনা। You are not allowed to talk here. চা দিতে বলেছি, চা খেয়ে বেরিয়ে যাও।” আমি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। আব্বু যখন কথা বললো তখন প্রক্টর আব্বু আর হাসিব দুইজনকেই থামার জন্য অনুরোধ করলো। হাসিবকে বললো উনি একজন গার্জিয়ান, আমার অফিসে এসেছে উনার সাথে তর্ক করোনা। অসভ্যটা তার পরেও চুপ করেনি।

আমার আব্বুটার জন্য কষ্টে আমার দম আটকে আসছিল। সারাজীবন আওয়ামীলীগ করার অসাধারণ প্রতিদান পেলো আজকে মানুষটা! আমি মাথা নিচু করে হাত মুঠ করে বসে রইলাম। চা আসলো। আব্বু চা নিলো। স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন চা নিচ্ছিনা কেন। আমি নিচের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলাম আমি চা খাইনা। সে এবার আরও তেড়ে উঠলো যেন।

“তুমি সবসময়ই এরকম উদ্ধত। ওইদিন রাতেও তুমি থানায় সিনক্রিয়েট করেছো!” আমি লোকটার চোখের দিকে ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। স্যার আব্বুকে বললো প্রভোস্ট আর ভিসি স্যারের সাথে কথা বলতে। প্রভোস্ট ম্যাম চাইলে হলে উঠতে পারব। নিজেকে আমার ফুটবল মনে হচ্ছিল তখন। যেখানে, যার কাছেই যাই, সে পাস করে আরেকজনের কাছে পাঠিয়ে দেয়!

আব্বু কথা শেষ করে বেরোলো। বাইরে বেরিয়েই আমি কেঁদে দিলাম। আব্বু বকতেসে কেন কথা বললাম সেজন্য। আমি কাঁদতে কাঁদতেই উত্তর দিলাম তোমার আর স্যারের মাঝখানে ও কথা বলার সাহস পাইলো কোথা থেকে? আমার জন্য আর কত ছোট হবা তুমি?” আব্বু আর কোনো কথা বললো না। আমার তখন আর কোনো আশাই নেই হলে ওঠার। খুব বাজেভাবে ভেঙে পড়েছিলাম আমি। দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করছিল। ভিসি স্যার যদি আবার আব্বুকে অপমান করে?

আমরা ভিসি স্যারের অফিসে আসলাম। স্যারের মিটিং ছিল। আবারও আধঘন্টার উপরে অপেক্ষা। আমি কাঁদতেছিলাম বসে বসে। অবশেষে আমাদের ডাক আসলো। গেলাম স্যারের রুমে। আব্বু পরিচয় দিল। স্যার বললো এই মেয়েটাকে হলের সামনে থেকে নিয়ে গেছিল না? আব্বু বললো হ্যাঁ। পরশু পরীক্ষা আর শ্যামলী থেকে জার্নি করা টাফ, এটাও বললো।

স্যার প্রভোস্ট ম্যামকে ফোন দিয়ে আমাকে হলে উঠতে দিতে বললেন। আমি এটা আশাই করিনি। ম্যাম নয়টায় লাগেজ নিয়ে হলে যেতে বললেন। আমরা শ্যামলী গেলাম লাগেজ আনতে৷

আমি হলে আর কখনো উঠতে পারবো ভাবিনাই। এমন একটা সাহসী, স্ট্রং, হারতে না শেখা মানুষকে আমার বাবা হিসেবে দুনিয়ায় পাঠানোর জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম।

সূত্র: দশ দিগন্ত

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com