আসন্ন নির্বাচন ও নেপথ্যের খেলা

সোমবার, ২৬ নভেম্বর ২০১৮ | ১১:০০ অপরাহ্ণ | 255 বার

যাক, শেষ পর্যন্ত বিএনপির ২০ দলীয় জোট, সঙ্গে বাছুর ঐক্যফ্রন্টও নির্বাচনে যাচ্ছে। পাঠক, দয়া করে এই প্রবাসী সাংবাদিককে একটা বাহবা দেবেন। আমি বহু আগেই এমনটা হবে তা লিখেছিলাম। কেউ বলতে পারেন, ঝড়ে কাক মরেছে, ফকির কেরামতি ফলাচ্ছে। সহৃদয় পাঠক বিশ্বাস করুন, এখানে ফকিরের কোনো কেরামতি নেই। ঝড় না হলেও কাক মরত। ফকির শুধু তা আন্দাজ করেছে। এখানেই একটা বাহবা তার প্রাপ্য।

উপমাটা ঠিক হয়নি। নির্বাচনে যোগ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপি মরেনি; বরং বেঁচে উঠেছে। এখন নির্বাচনে জিতলে ক্ষমতায় যাবে, না জিতলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে বেঁচে থাকবে, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করতে পারবে। নির্বাচনে না গেলে এই ফ্রন্টের অবস্থা হতো পঞ্চাশের কবি আশরাফ সিদ্দিকীর কবিতার মতো। ‘সাপে কেটে মারা গেলো কবিতা আমার।’ এখানে দু-দুবার ভুল করার সাপ বিএনপিকে দংশন করত। তখন বেহুলার স্বামী লখিন্দরের মতো অবস্থা হতো বিএনপির।

বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই খবরটা প্রচারিত হওয়ার পর এক বাংলাদেশি বন্ধু আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে বললেন, ‘অত উল্লসিত হবেন না’, বিএনপি তার থলের আসল বিড়াল এখনো দেখায়নি। এমনও হতে পারে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পর গতিক সুবিধার নয় দেখলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কারচুপি করছে ধুয়া তুলে তারা প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিল এবং নির্বাচন বর্জন করল। হয়তো বিদেশি পেট্রনদের চাপে তারা এখন নির্বাচনে এসেছে। পরে নির্বাচনে কারচুপির ধুয়া তুলে পেট্রনদের বোঝাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না তা তো আমরা আগেই বলেছিলাম। আমাদের কথাই তো সত্য হলো।

তাঁকে বললাম, এটা সত্য বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্র-বৈশিষ্ট্য হলো নির্বাচনে তারা জয়ী হলে আর কারচুপির ধুয়া তোলে না। কিন্তু হার হচ্ছে দেখলেই কারচুপির ধুয়া তোলে। এমন কথাও বলে, আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচন জয় ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। তবে এবার এই খেলা চলবে না। প্রথম কথা, এটা সিটি করপোরেশনের মেয়র অথবা উপজেলা চেয়ারম্যান পদের নির্বাচন নয় যে দলের নির্দেশ একজন বা দুজন প্রার্থী মেনে নিলেন। এখানে সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি জোট বা ঐক্যফ্রন্টকে লড়তে হবে ৩০০ আসনে। এই ৩০০ আসনেও সব প্রার্থী বিএনপির নয়। তাদের জোটের ১৯টি দলের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোও নির্বাচনে প্রার্থী দেবে। তারা নির্বাচন করার জন্যই ঐক্যফ্রন্টে এসেছে, নির্বাচন বর্জন করার জন্য নয়।

নির্বাচনের মাঝখানে বিএনপি কোনো কারণে নির্বাচন বর্জন ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ডাক দিলে সব শরিক দলের প্রার্থীরা কেন, বিএনপিরও সব প্রার্থী সাড়া দেবে কি না সন্দেহ। তার পরও বিএনপি এই আত্মঘাতী পথে পা বাড়ালে ঐক্যফ্রন্ট তো ভাঙবেই, বিএনপিরও ঐক্য আর থাকবে না। যদি ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিত, তাহলেও ফ্রন্টের ঐক্য অটুট থাকত না। যাঁরা ঐক্যফ্রন্টে এসেছেন তাঁরা বড় দল বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নির্বাচন করে জয়ী হবেন, ক্ষমতায় যাবেন এই স্বপ্ন নিয়েই ঐক্যফ্রন্টে এসেছেন। নির্বাচন বর্জনের লক্ষ্য নিয়ে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজনীতির দণ্ডকারণ্যে নির্বাসিত হবেন—এই লক্ষ্য নিয়ে কেউ ঐক্যফ্রন্টে আসেননি।

নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলে ঐক্যফ্রন্ট এখনই ভেঙে যেত, বিএনপির ২০ দলীয় জোটেও চিড় ধরত। আর খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তারেক রহমানের দণ্ডাদেশ বাতিল ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না এটা জানলে ড. কামাল হোসেন তাঁর দুর্দিনের বন্ধু ডা. বদরুদ্দোজাকে ছেড়ে বিএনপির মঞ্চে এসে উঠতেন না। বিএনপি কখনো জামায়াতের সঙ্গ ছাড়বে না, এটা জেনেও তারেক ও জামায়াতের একই কম্বলের নিচে ঢুকতেন না। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময় যখন ডা. বদরুদ্দোজা বাদ পড়েন এবং বিএনপি তারেক রহমানের নির্দেশে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মেনে ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হয়, সেদিনই আমি ধরে নিয়েছিলাম, বিএনপি সদলে নির্বাচনে যাচ্ছে। এটা বোঝার জন্য আমার কোনো পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হয়নি। সাধারণ জ্ঞানেই এটা বুঝতে পেরেছি।

এর পেছনে কিছু দেশি-বিদেশি খেলাও আছে। বিদেশে দীর্ঘদিন ধরে আছি বলে খেলায় বিদেশি অংশটা কিছু কিছু বুঝতে পারি। জানতেও পারি। বিএনপি নেতারা প্রথমে ধরে নিয়েছিলেন, ভারতকে বুঝিয়েসুঝিয়ে এবং হাসিনা সরকারের ওপর প্রসন্ন নয়, এমন কয়েকটি পশ্চিমা সরকারের সাহায্যে তারা হাসিনা সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে তাঁদের দাবি মানতে বাধ্য করে তাঁদের পছন্দসই নির্দলীয় সরকারের অধীনে ২০০১ সালের মতো নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি করতে পারবেন। তাঁদের আশা পূর্ণ হয়নি।

আমার ধারণা, বিএনপির ‘খালেদা-তারেক নেতৃত্ব’ তাদের বিদেশি পেট্রনদের কাছে ক্রেডিবিলিটি হারিয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বিএনপির অতি মাখামাখি ভারতকে তো খুশি করেইনি, অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমেরিকার ট্রাম্প সরকারেরও তা পছন্দ হয়নি। বিএনপি-নেতৃত্বে তাঁরা ঘোড়া বদল দেখতে চান। তাঁদের পছন্দের ঘোড়া।

ফলে বাংলাদেশে ড. কামাল হোসেনের ভাগ্য আবার খুলে গেল। যিনি দেশের রাজনীতিতে ফসিল হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি আবার জীবন্ত ঘাস হয়ে উঠতে চাইলেন। শেষ বয়সের শেষ খেলায় বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গ নিতেও তাঁর চক্ষুলজ্জায় আর বাধল না। খালেদা জিয়া তো জেলে। মুক্ত তারেক বিদেশে বসে এই অবস্থাটা বুঝতে পেরেছেন এবং তাঁর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। আন্দোলন করে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানো যাবে না। সুতরাং আন্দোলনের হুমকি দিয়ে, সন্ত্রাসের ভয় দেখিয়ে, সাত দফার মতো কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে তার অবস্থান থেকে নড়ানো না গেলে নির্বাচনে দল আরো ভারী করে যেতে হবে এবং একমাত্র নির্বাচনে জয়ী হলেই তাঁরা মাতা-পুত্র বাঁচতে পারবেন, এটা তারেক বুঝতে পেরেছেন।

এ জন্যই ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির দ্রুত যোগদান। কিন্তু ফ্রন্টে তাদের যোগদানেও একটা বড় বাধা ছিলেন ডা. বদরুদ্দোজা। দুই ‘ডাক্তার’ মিলে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে থাকলে শুধু ফ্রন্টের নেতৃত্ব নয়, বিএনপির নেতৃত্বও মাতা-পুত্রের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে (বিদেশি পেট্রনদেরও ইচ্ছা তাই), এটা একটা বড় ভয়। ডা. বদরুদ্দোজা এমনিতেই তারেকের প্রচণ্ড বিরোধী। তাঁকে ফ্রন্ট থেকে বাদ দিতে পারলে তারেক রহমান নিরাপদ।

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com