সাত স্ত্রী আর ১১ ছেলে-মেয়ে নিয়ে ১৯ জনের সংসার

সোমবার, ১৯ আগস্ট ২০১৯ | ১০:০০ অপরাহ্ণ | 237 বার

সাত স্ত্রী আর ১১ ছেলে-মেয়ে নিয়ে ১৯ জনের সংসার

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থেকে চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনার বিস্তৃত প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। সেই বিস্তৃত মেঘনার বুকে হাজার হাজার সারিবদ্ধ নৌকা। সেই নৌকায় হাজার হাজার জেলের বাস। সঙ্গে রয়েছে তাদের পরিবার।

নৌকাতে ঘরবাড়ি আর জীবিকার উৎস থাকায় ‘জলেই জন্ম, জলেই মৃত্যু, জলেই বসবাস, নাগরিক হয়েও তারা নিজ দেশে পরবাস’ স্লোগানটি তাদের সঙ্গে লেপ্টে আছে। এসব লোকেরা ‘মানতা’ হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। তবে এ উপজাতির জীবন ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বৈচিত্রময় নিয়ম।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যুগযুগ ধরে এরা মেঘনার বুকে বসবাস করছে। স্থানীয়সহ সবার চোখের সামনে তাদের অবস্থান হলেও তারা লোকচক্ষুর আড়ালে। পেশায় মৎস্য শিকারি থাকায় ডাঙ্গাবাসীর প্রতিদিনের রসনা বিলাসের হাজার হাজার সামুদ্রিক মাছের জোগান দেয় তারা। তবে নিজেদের রসনা বিলাসের কোনো সুযোগ নেই।

তারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞ। মৌলিক অধিকার বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ খাবার পানি তাদের কাছে অধরা বিষয়। অনিয়ন্ত্রিত প্রসব, বাল্য, বহু বিয়ে ও কুসংস্কারে ভরপুর মানতা সম্প্রদায়দের জীবন। তাদের নেই কোনো জন্ম নিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র।

জেলার মেঘনাপাড়ে দেখা যায়, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মেঘনার ভাসমান নৌকাতেই কাটে মানতা সম্প্রদায় লোকদের জীবন। মৌলিক অধিকার ও নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত সভ্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে স্থানীয়রা বলেন ভাসান আর জেলেরা পরিচয় দেয় ‘মানতা’ নামে।

জেলার রায়পুর থেকে রামগতি পর্যন্ত মেঘনা নদীতে প্রায় ৯০০ নৌকায় দশ হাজারের মতো মানতা সম্প্রদায় সপরিবারে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

কমলনগরের মতিরহাট ঘাটে শতাধিক মানতা নৌকার বহর দেখা যায়। একটি বহরের সরদার লোকমান মানতার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, ঘরবাড়ি বা জমি না থাকায় তারা ডাঙ্গায় বসবাস করেন না। নৌকাই ঘরবাড়ি, এখানেই সাত স্ত্রী আর ১১ ছেলে-মেয়ে নিয়ে ১৯ জনের সংসার তার। মাছ ধরে বিক্রি করে খান, এটাই তাদের জীবন।

শুধু খাওয়া ও স্ত্রী ভোগ ছাড়া অন্য কিছুই চিন্তা করে না এ সম্প্রদায়ের লোকেরা। এখানেই সব শান্তি তাদের।
মানতা সম্প্রদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আরেক সরদার জাফর উল্লা জানান, বেদের মধ্যে অনেক উপ-সম্প্রদায় রয়েছে। মালবৈদ্য, বাজিকর, শালদার বা মানতা। মানতারা মূলত নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে।

জনগোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্তির বর্ণনা দিতে গিয়ে জাফর মানতার তিন নম্বর স্ত্রী পিরোজা বেগম জানান, ছোট বেলায় মেঘনায় ভিটেমাটি নিয়ে যায়। আমি তখন অবিবাহিত। জাফর মানতার তিন নম্বর স্ত্রী হিসেবে সংসার শুরু করি। সে নদীতে থাকে, জাতে মানতা, তখন থেকে আমিও মানতা হয়ে যাই।

আবদুল, হাবিব, জব্বার মানতাসহ আরো কয়েক জন জানান, মানতারা জীবনের কোনো না কোনো সময় নদী ভাঙনের শিকার। উপকূলীয় বিভিন্ন নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসরত মানুষরাই সম্পদ হারিয়ে জীবন বাঁচাতে মানতা সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

আর এভাবেই উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বছর জীবন সংগ্রামী নতুন মানতাদের সম্প্রসারণ ঘটছে। মানতায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর বহর নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছ ধরতে ঘুরে বেড়ায়। অনেক সময় জনমানবহীন দ্বীপাঞ্চলে এরা ভিড় করে।

জীবন ও জীবিকার পদ্ধতি সর্ম্পকে জানতে চাইলে আমেনা খাতুন জানান, নদীর উচু ঢেউ বা প্রাকৃতিক দূর্যোগে শক্ত হাতে নৌকা চালাতে পারি। জলের গতির সঙ্গে সখ্যতা জন্মগত অধিকার। তিনি আরো জানান, ছোট বয়সেই মা ও বাবার কাছে মাছ ধরার হাতেখড়ি পাই। কোনো দিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।

এগার বছর বয়সে সহযাত্রী নৌকার যুবক সফির সঙ্গে বিয়ে হয়। করুন সুরে তিনি বলেন, নদীর বুকে ভাসমান জীবন খুব কষ্টের। ঝড়-তুফানেও বসে থাকার অবস্থা নেই। এখন নদীতে আগের মতো মাছ নেই। মাছ ক্রমেই কমে আসছে। ইলিশে অনেক লাভ। কিন্তু আমাদের পুঁজি নেই। তাই ইলিশ ধরার সরঞ্জাম নেই। কোনো কোনো দিন দুই থেকে তিনশত টাকার মাছ বিক্রি করে চাল, ডাল কিনে সংসার চালাই। আবার বহু দিন শূন্য হাতে বৈঠা চালাই।

যখন নদীতে মাছ কম থাকে বা ইলিশ অভিযান চলে, তখন আমাদের কষ্টের দিন দীর্ঘ হয়। কিন্তু কি করব, কোথায় যাব, কি খাব, আমাদের কেউ সাহায্য করে না।

মানতারা নদীতে কি করে, জানতে চাইলে মধ্য বয়স্ক লুৎফুর রহমান বলেন, ভাসান বা মানতারা মূলত ছোট বা মইয়া জাল ও বরশি দিয়ে মাছ ধরে। নদীপাড়ের স্থানীয় বাজারে সে মাছ বিক্রি করে। আমরা প্রধানত, চিংড়ি, পোয়া, ট্যাংরা, গলসা, পাঙ্গাস, কাওন মাছ ধরি। খাদ্য কেনার পর যা থাকে তা দিয়ে জাল আর নৌকা মেরামত করি।

ঠিকানাবিহীন জীবনের কারণে কোনো আড়ৎদার আমাদের দাদন না দিলেও শোষণ করতে কার্পণ্য করে না।
একই অভিযোগ করে ফুলবানু জানান, কখনো কখনো বেশি ও বড় মাছ পেলে স্থানীয় আড়ৎদার বা প্রভাবশালীরা কম-মূল্যে তাদের সে মাছ কিনে নিয়ে যায়। সম্প্রতি স্থানীয় জেলেরাও নদীর বিভিন্ন স্থানে জাল পাততে মানতাদের বাঁধা দিচ্ছে।
মাঝে মধ্যে তাদের নৌকা জলদস্যুদের শিকার হয়। দস্যু বাহিনী তাদের নারী ও শিশুদের নির্যাতন করে।

বিয়ে ও তালাক সম্পর্কে শাহ আলম মানতা জানান, কর্ম জীবন যা-ই হোক, জীবনের নানা ক্ষেত্রে এ সম্প্রদায়ের রয়েছে বৈচিত্রময় কিছু রীতি। মুসলমান হলেও বিয়ের রীতি ডাঙ্গাবাসী থেকে একটু ভিন্ন। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় পছন্দের মেয়েটিকে তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়। এরপর হুজুরের সাহায্যে মাঝে মাঝে কলেমা পড়ানো হয়।

আবার দাম্পত্য কলহের কারণে বিয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিলে বধূটি স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তালাক হয়ে যায়। তাদের বিয়ের কোনো নিবন্ধন হয় না।

বাল্য ও বহু বিয়ে সম্পর্কে মজুচৌধুরীর ঘাটের সরদার ফারভেজ মাঝি বলেন, এ পর্যন্ত সাতটি বিয়ে করেছি। পাঁচ স্ত্রী মাছ ধরে বিক্রি করে। এরপর তার হাতে টাকা তুলে দেয়। পাঁচ স্ত্রীকে নিয়ে বেশ সুখেই আছি। আমার ছোট বউয়ের বয়স ১৬ বছর। তার নাম রুপবানু।

সব বহরের নারীরা ১২-১৪ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন বলে স্বীকার করেছেন। তারা জানান, বিয়ের সময় নদীর পাড়ের বাড়ির বাগানে বিয়ের আসর বসে। তখন তারা গান বাজনা করে, কিন্তু বিয়ের খানাপিনে ওই নৌকাতেই হয়।

জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও সন্তান লালন সর্ম্পকে কুলছুম বলেন, জন্ম নিয়ন্ত্রণ করি না। রোকা বেগম জানান, ১৩ বছরের স্বামীর সংসারে হাল ধরতে নৌকার হাল ধরতে হয়েছে। কিশোরী বয়সের বিবাহিত জীবনে রোগাক্রান্ত। এরইমধ্যে ৯ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি।

সন্তান গর্ভধারণ আর সন্তান লালন সম্পর্কে বলেন, রুমা বলেন, তিনটি সন্তান রয়েছে। প্রতিটি সন্তান জন্ম দানের কয়েক ঘণ্টা আগেও নদীতে মাছ ধরেছি। এখানে কোনো চিকিৎসা চলে না। পানিতে পড়ে যাওয়া শিশুকে রক্ষা করতে নৌকার ভেতরে বেঁধে রাখি। কে, কিভাবে চলল। কে দেশের ক্ষমতায় রয়েছে, এ ব্যাপারে আগ্রহ নেই।

হাফিজ মানতা জানান, সামান্য তুফান এলে দুর্ভোগের সীমা থাকে না। ইচ্ছা করলেই পেশাটি ছাড়া যাচ্ছে না। ঈদসহ যেকোনো উৎসবের দিন আনন্দ আসে না। ঈদের দিন মাংস দিয়ে পেট ভরে ভাতের স্বাদ পাই না। ছেলে মেয়েদের নতুন জামা কিনে দিতে পারি না। ডাঙ্গার গরিবেরা বিভিন্ন সময় যাকাত, ফেতরা বা দান খয়রাতের মতো সাহায্য সহযোগিতা পায়। শীতের মৌসুমে অনেকে শীত বস্ত্র দিয়ে যায়।

অথচ আমাদের পোড়া কপাল, আমরা সব কিছু থেকে বঞ্চিত। শীত, গ্রীষ্ম, রোদ, বৃষ্টি সব সময়ই আমরা অসহায়। আমাদের খবরও জানে না কেহ।

এ সম্প্রদায়ের মৃত্যু সর্ম্পকে রহমান সরদার জানান, আগে মানতাদের মৃত্যু হলে কলা গাছের ভেলায় মরদেহ ভাসিয়ে দেয়া হতো। এখন নদীর পাড়ে বা কোনো পরিত্যক্ত ভিটেতে মরদেহ দাফন করা হয়। কেউ জমি দান না করলে বহরের সবাই চাঁদা তুলে কবরের জমি কিনে মাটি দেয়।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে সমাজসেবা অধিদফতর বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। এরইমধ্যে এ সম্প্রদায়ের লোকজনকে হাতে কলমে ক্ষুদ্র কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তিসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুক। আমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদের সহায়তা করব।

সূত্র: দশ দিগন্ত

Comments

comments

সোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্রশনিরবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

২০১৭ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। নবধারা নিউজ | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Development by: webnewsdesign.com